আবেগের বসতবাড়ি
প্রকাশিত হয়েছে : ৭:৩৫:৩২,অপরাহ্ন ২০ আগস্ট ২০১৬ | সংবাদটি ২২০০ বার পঠিত
সাফিয়ার বেশ জ্বর। জ্বরে সারা শরীর পুড়ছে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে আকাশে জমা হওয়া কালো মেঘের দিকে তাকিয়ে আছে বেশ সময়। মনে মনে ভাবছে বৃষ্টি নামলে যদি একটু ভেজা যেত! আজকাল বৃষ্টিতে নামলেই জ্বর চলে আসছে। জ্বর কেন আসে, কোথায় আসে, কোন যায়গা দিয়ে প্রবেশ করে অদ্ভুত সব প্রশ্ন এসে ভিড় জামায়। আসলে কটা প্রশ্নের জবাব মানুষের জানা আছে! জানা নেই।
বড় মেয়টার বয়স পনের ছুঁই ছুঁই, বয়সের তুলুনায় তাকে অনেক বেশি কাজ করতে হয়। প্রতিভোর, ঘুমভাঙা সকালে সাফিয়ার বের হওয়া তারপর ছটা পর্যন্ত বেশ কয়েকটা অফিসে তার কাজ। ঝাঁড়ু দেয়া, মোছা তারপর চা করা, ফটোকপি, ব্যাংকিং কাজগুলো করতে হয় ভিন্ন ভিন্ন অফিসের সময় মেইন্টেইন করে। সকালে খাবার জন্য একবার আর দুপুরে একবার এই বাড়িতে যাওয়া। তাড়াহুড়ো করে রোজার কাজ গুলো দেখে সাফিয়া। একটু দেরি হলে মেয়েকে কটু কথা বলতেও ভুল করে না! জানিস না আমার সময় নেই। খাবার কই! সারাদিন করিস কি! তোকে পালা আর কুকুর পালা সমান কথা। রোজা কথা বলে না। যতদ্রুত সম্ভব মায়ের জন্য খাবার রেডি করে।
কয়েকদিন আগের কথা। দুপুরে বাড়ি ফিরে দেখে রোজা বসে বসে কাঁদছে। ওকে কাঁদতে দেখে প্রশ্ন করে,
‘কাদিস কেন?’
তড়িঘড়ি করে চোখ মোছে রোজা। ‘ কই কাদি না তো।’
‘ভানিতা বাদ দিয়ে কি হয়েছে তাই বল।’ সাফিয়ার কণ্ঠে রুক্ষতা।
‘আজ বাবা এসেছিল।’
‘তাড়িয়ে দিয়েছিস?’
‘না।’মাথা নিচু করে থাকে রোজা।
‘আদর করে ভাত খেতে দিয়েছিলি?’ ঘাড় নাড়ে রোজা। ‘ হ্যাঁ।’
‘তারপর?’
‘এক হাজার টাকা চেয়েছিল, দিতে পারিনি।’
সাফিয়ার সহ্য হয় না। দ্রুত এগিয়ে যায়। রোজার গালে চটাস করে একটা থাপ্পড় মারে। ‘ শয়তান, ভালো হবি না। বাবা এসেছিল ইস, কী দরদ!’ বিদ্রুপের স্বরে কথা বলে। থাপ্পড় খেয়ে যেন রোজার একদম কিচ্ছু হয়নি। ভদ্র-শান্ত, ভেজা গলায় বলে, ‘ তোমার না হয় কিছু হয় না মা, আমার তো বাবা। আমি যে পারি না।’
আরেকটা থপ্পড় মারতে ইচ্ছা করলেও কেন যেন থাপ্পড় মারা থেকে বিরত থাকে সাফিয়া। চুপ করে চলে যায়। নিজের ছোট্ট কামরাটায় গিয়ে বসে। পৌর এলাকায় সামান্য কিছু টাকা দিয়ে টিনসেডের দুটো রুম ভাড়া করে থাকে ওরা। একটা রুমে থাকে সাফিয়া আরেক রুমে রোজা আর মিতু দু’বোন। মিতু মেয়েটার বয়স দশ বছর হতে কয়েক মাস বাকি। শুধু মেয়ে দুটোর মুখের দিকে তাকিয়ে দিন রাতের পরিশ্রম সাফিয়ার। তারা মানুষের মতো মানুষ হোক। রোজা ঘরোয়া সব কাজের ফাঁকে ফাঁকে ঠিকই পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। স্যারেরা ও তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এস.এস.সি তে যখন গোল্ডেন এ প্লাস পেল রোজা সবাই তাজ্জব। এত কাজ, কষ্টের ভেতর মেয়েটা কিভাবে এমন রেজাল্ট করলো! সাফিয়া চমকায় নি। তার যেন জানাই ছিল তার মেয়ে এমন রেজাল্ট করবে। সব ঠিক থাকলেও সমস্য শুধু একটা যায়গায় ওই বদমাশটাকে একদম ভুলতে পারেনি মেয়েটা। কতোকরে বুঝিয়েছে। ও বাবা নামের কলঙ্ক। এমন বাবার পরিচয় দিতে হয় না। নাহ মেয়েটা ভুলতে পারেনি।
বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। চোখের সামনে ভেসে ওঠে আঠার বছর আগের কথা। বাবা-মা দেখে শুনেই বিয়ে দিয়েছিল সুমনের সাথে। মাইক্রো ড্রাইভার সুমন দেখতে শুনতে মন্দ না। গরিব ঘরের মেয়েকে আর কেই বা বিয়ে করতে আসবে। সুমনকে নিয়ে কোনো আক্ষেপও ছিল না । স্বামী হিসাবে মনে প্রানেই মেনে নিয়েছিল। বিয়ের বছর কয়েক পেরোতেই ধীরে ধীরে সুমনের আসল চেহারা প্রকাশ পেতে থাকে। রোজা তখন ছোট। মাঝে মাঝেই মদ খেয়ে বাড়ি ফিরতো। টাকার জন্য চাপ দিত, টাকা এনে দে। সাফিয়া টাকা পাবে কোথায়! গরিব বাবা-মায়ের কাছ থেকে কয়েকবার টাকা এনেও দিয়েছে। যতো দেয় তার চাহিদা ততোই বাড়তে থাকে। চলে নির্যাতনের রুলার। শুধু মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে সব সহ্য করে। নিতু গর্ভে থাকাকালীন সময়ে উধাও হয়ে যায় সুমন। কোনো খবর নেই। আত্মীয় স্বজন সবার কাছে খোঁজ নিয়েও কোনো হদিস মেলে না সুমনের। কেউ জানে না সে কোথায়। কূল নাই, কিনারা নেই। সামনে সীমাহীন সমুদ্র। সাফিয়ার পক্ষে গরিব বুড়ো বাবা-মায়ের ঘাড়ে বোঝা হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। সাফিয়া বাবার একমাত্র মেয়ে। মনে মনে ভাবতো একটা ভাই যদি থাকতো সে হয়তো ফেলে দিতে পারতো না। এর ভেতর নিতু পৃথিবীতে আসে আর বাবা চলে যায়। আসা যাওয়ার খেলায় চরম অসহায় হয়ে পড়ে শাফিয়া। বাধ্য হয়েই কাজের খোঁজে নামে। গ্রামে তো আর কাজ মেলে না। গ্রাম ছেড়ে পৌর এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে প্রথমে বাড়ি বাড়ি কাজ করতো। তারপর কিছু মানুষের সহযোগিতায় কয়েকটা অফিসে কাজ জুটে যায়।
হঠাৎ একদিন সুমন ভাড়া বাড়িতে এস হাজির। সুমনকে দেখে সাফিয়া অবাক হয়। রাগও হয়। ‘ কোথায় ছিলে এতোদিন?’ প্রশ্ন করে সাফিয়া।
‘আমি আরেকটা বিয়ে করেছি।’
‘ভালো। বিয়ে করেছো বলে, তোমার আরেকটা বউয়ের, সন্তানের খোঁজ নেবার আর প্রয়োজন মনে করো নি!’
‘খোঁজ নিতেই তো এলাম।’
‘হা হা হা। ’ সাফিয়া হেঁসে ওঠে। কাঁদবে কেন সে! তার কি দুঃখ আছে নাকি! সয়ে গেছে সব। মনে মনে ভাবে, মানুষ এমন হয়, পাশবিক! দশ বছর পর এসেছে খোঁজ নিতে।
‘আমার মেয়ে টা কই! রোজা?’ কথা বলে সুমন।
‘র্সাটআপ, কিসের মেয়ে? তোমার আবার কিসের মেয়ে? বেরিয়ে যাও, আর যদি কোনোদিন আসো আমি লোকজন ডেকে তোমাকে ধরিয়ে দেব।’
সুমন চলে যায়। রোজার চোখে পানি। কী বোঝে মেয়েটা। তাকে তো বলেছে তার বাবা নেই, মরে গেছে। রক্তের বোধহয় একটা টান আছে ওর ভেতর। তারপর থেকে গোপনে গোপনে সুমন আসে। যখন সাফিয়া থাকে না রোজার সাথে কথা বলে চলে যায়। এদিকে পাড়ার মহিলারা নানা সমালোচনা আর গুঞ্জন ছড়ায়। রোজাকে বলে দিয়েছে, লোকটাকে যেন ঠাঁই না দেয়। সবাই আজেবাজে কথা বলে। কে শোনে কার কথা।
চোখের পানিতে বালিশটা কখন যে ভিজে ওঠে টের পায় না। সেও কি ভুলতে পেরেছে সুমনকে?
বৃষ্টি পড়া শুরু হয়েছে। ঝপঝপ করে একনাগাড়ে পড়ছে। সাফিয়া জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকে বাইরের দিকে। ওর মরা স্বপ্ন গুলো ডালপালা গজিয়ে বিরাট এক বৃক্ষ হয়েছে যেন। আবেগেরা বাড়ি ঘর বানিয়ে, জগত বানিয়ে বুকের ভেতর দাপাদাপি করে। যদি আবেগ দেখা যেত, আবেগের বাড়ি ঘর জানা যেত তাহলে না হয় জাপটে ধরে আবেগকে তুলে ধরে আছড়ে ফেলা যেত কোনো এক ডাস্টবিনে।
হঠাৎ কপালে কারো হাতের স্পর্শে চমেকে ওঠে সাফিয়া। রোজা। ‘মা অনেক জ্বর দেখছি। দাঁড়াও ওষুধ নিয়ে আসি। ’ কথা শেষ করেই চলে যায় রোজা।
বাইরের জ্বরটা দেখলো মেয়েটা। ভেতরেও যে জ্বর তা কি সে বোঝে!
মোহাম্মদ অয়েজুল হক
Hoque9203@gmail.com