পুণ্য ও প্রাপ্তির মৌসুম হজ, শায়খ ড. আবদুর রহমান বিন আবদুল আজিজ সুদাইস
প্রকাশিত হয়েছে : ১২:৫৩:৩৮,অপরাহ্ন ০২ আগস্ট ২০১৯ | সংবাদটি ৩৭৬ বার পঠিত
আমরা এখন উপনীত হজের মাস ও বড় হজের দিনগুলোর দ্বারপ্রান্তে। পুণ্য লাভ, পাপ মাফ এবং কল্যাণ ও নেকি অবতরণের উৎসে। অঢেল উপকারিতার ঝরনায়। এই তো বাকি আর ক’টা দিন। মুসলিম উম্মাহ অবস্থান করছে নির্ধারিত কাল ও স্থানগত মিকাত থেকে দুই ধনুক বা তার চেয়ে কম দূরত্বে। আল্লাহর সম্মানিত ঘরের হজের ফরজ আদায়ে। ইসলামের স্তম্ভগুলোর পঞ্চমটি সম্পাদনে। আল্লাহ তায়ালা বলেন : ‘আর এ ঘরের হজ করা হলো মানুষের ওপর আল্লাহর প্রাপ্য; যে লোকের সামর্থ্য রয়েছে এ পর্যন্ত পৌঁছার।’ (সূরা আলে ইমরান : ৯৭)।
অতএব হে আল্লাহর সম্মানিত ঘরের অতিথিরা, আপনাদের স্বাগতম। আপনারা এসেছেন আপনজনের কাছে। আপনারা প্রবেশ করেছেন সসম্মানে। আপনাদের আগমনে পবিত্র দুই হারামের নেতৃত্ব ও নাগরিকরা সৌভাগ্যবান। সুখময় হোক আপনাদের নিরাপদে পৌঁছা এবং প্রত্যাশা প্রাপ্তি।
ওহে মুসলমান, যে মহান ও গুরুতর বিষয়ের ওপর দাঁড়িয়ে আছে হজের মজবুত ভিত, তা হলো তাওহিদ। একে আল্লাহর জন্যই বিশিষ্ট করা এবং অন্যদের থেকে ইবাদতকে শুধু তাঁর জন্যই বরাদ্দ রাখা। এটি বান্দার ওপর আল্লাহর প্রধান হক। আল্লাহ তায়ালা বলেন : ‘আপনার পূর্বে আমি যে রাসুলই প্রেরণ করেছি, তাঁকে এ আদেশই প্রেরণ করেছি যে, আমি ব্যতীত অন্য কোনো উপাস্য নেই। সুতরাং আমারই ইবাদত কর।’
(সূরা আম্বিয়া : ২৫)।
সেহেতু হজের সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য ও উপকারিতা হলো নির্ভেজাল তাওহিদ বাস্তবায়ন করা। হাজীরা যে তালবিয়া পড়তে থাকেন এবং যার ধ্বনিতে বালাদে আমিন বা নিরাপদ শহর প্রকম্পিত হয়ে ওঠে, সেটি তো তাওহিদ, ঈমান, আনুগত্য ও আত্মসমর্পণেরই প্রতীক। জাবের বিন আবদুল্লাহ (রা.) নবী (সা.) এর তালবিয়া সম্পর্কে বলতে গিয়ে একে তিনি তাওহিদের তালবিয়া বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেন, ‘তিনি তাওহিদ-সংবলিত তালবিয়া পাঠ করেন, লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা শারিকা লাক।’ (অর্থাৎ আমি হাজির, হে আল্লাহ, আমি হাজির। তোমার কোনো শরিক নেই, আমি হাজির। নিশ্চয়ই যাবতীয় প্রশংসা ও নেয়ামত তোমার এবং রাজত্বও, তোমার কোনো শরিক নেই)।
তাওহিদ কায়েমের জন্যই এ মহান ঘরের ভিত রাখা হয়েছে। ‘যখন আমি ইবরাহিমকে বাইতুল্লাহর স্থান ঠিক করে দিয়েছিলাম যে, আমার সঙ্গে কাউকে শরিক করো না।’ (সূরা হজ : ২৬)। অতএব দয়াময়ের বান্দারা আপনাদের প্রতিদানদাতা একক রবের কাছেই প্রত্যাশা ও প্রার্থনা করুন। আল্লাহর সঙ্গে অন্য কাউকে ডাকবেন না, অন্য কারও কাছে কিছু চাইবেন না।
আল্লাহর সম্মানিত ঘরের হাজীরা, আপনারা সম্মানিত দুই মসজিদের উঠানে আগমনকারী অগ্রবর্তী দল। আপনাদের মন উদগ্রীব হজের মহান সব ইবাদতের জন্য। মহিমান্বিত স্থানগুলোতে অবস্থানের জন্য। অতএব আল্লাহর জন্য ভাইদের সঙ্গে প্রীতিময় ও দয়াময় আচরণ করুন। আল্লাহর সন্তুষ্টি তালাশে সহমর্মী ও সহযোগী হয়ে চলুন প্রিয়জন ও ঈমানের সুবাসে নিবেদিত বাছাইকৃত লোকদের সঙ্গে। আপনাদের উদ্দেশ্যের মহত্ত্বের সামনে গলে ধুয়ে যায় পোশাকের সৌন্দর্য, বংশের গরিমা, উপাধি ও মর্যাদার কৌলীন্য। ইসলাম মানবিক সম্পর্ককে সুদৃঢ় করে, আর হজের উপকারী সবচেয়ে বেশি যে দিক এ সম্পর্ককে সুদৃঢ় করে, তা হলো ইসলামের জামাতগত আত্মিক একতা। যার সামনে মøান হয়ে যায় সব বিপদ ও সংকট। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বলেন, ‘আপনাদের এ উম্মত সব তো একই ধর্মের অনুসারী এবং আমি আপনাদের পালনকর্তা; অতএব আমাকে ভয় করুন।’ (সূরা মোমিনুন : ৫২)। আল্লাহ জাল্লা তায়ালা আরও বলেন, ‘মোমিনরা তো পরস্পর ভাই ভাই।’ (সূরা হুজুরাত : ১০)। আল্লাহ তায়ালা অন্যত্র বলেন, ‘আর তোমরা সবাই আল্লাহর রজ্জুকে সুদৃঢ় হস্তে ধারণ কর; পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।’ (সূরা আলে ইমরান : ১০৩)।
ঈমানি ভাইয়েরা, এ পবিত্র প্রাঙ্গণ যেখানে আপনারা মোবারক দিনগুলো কাটাচ্ছেন, মহান প্রভু একে এমন কিছু বৈশিষ্ট্যে বিশেষিত করেছেন, যা অন্যকে দেননি। যার মধ্যে সবচেয়ে স্পষ্ট বৈশিষ্ট্য হলো স্থিতি ও নিরাপত্তার নেয়ামত। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘(স্মরণ করুন) যখন আমি কাবা গৃহকে মানুষের জন্য সম্মিলন স্থল ও শান্তির আলয় করলাম।’ (সূরা বাকারা : ১২৫)।
মানুষের সব চেষ্টাকে অক্ষম বানিয়ে দেওয়া রবের এ নিরাপত্তা হারাম এলাকা অস্তিত্বে আসা থেকে নিয়ে শুরু হয়ে কেয়ামত সংঘটিত হওয়া পর্যন্ত বলবৎ রয়েছে এবং থাকবে। এ নিরাপদ নগরী থেকে কোনো অবস্থাতেই তা শিথিল হবে না। যে কেউ এতে বিঘœ ঘটাতে চাইবে আল্লাহ তাকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি আস্বাদন করাবেন। তিনি এরশাদ করেন, ‘আর এখানে যে সামান্যতম পাপাচারের ইচ্ছে পোষণ করবে তাকে আমি অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি প্রদান করব।’ (সূরা হজ : ২৫)। এখানকার কোনো ঘাস কাটা যাবে না, এখানকার কোনো কাঁটা তোলা যাবে না। এখানকার কোনো শিকারি প্রাণী তাড়ানো যাবে না, এমনকি পাখি, প্রাণী, উদ্ভিদ ও জড়বস্তুগুলোও সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা ও অবিরাম নিশ্চয়তায় থাকবে। তাহলে কীভাবে মুসলিমের দিকে চোখ তোলাও কত গর্হিত হতে পারে যার রক্ত, সম্পদ ও সম্মান সর্বদা এবং সবখানে নিরাপদ? এ অবিচ্ছিন্ন সুদৃঢ় নিরাপত্তার পর ইসলামের দয়া, মমতা, শান্তি, সম্প্রীতি ও উদারতার দাবির চেয়ে আর কোনো বলিষ্ঠ দাবি কি হতে পারে?
সম্মানিত হাজী সাহেবান, আল্লাহর দোহাই, এ নিরাপত্তার নেয়ামত বজায় রাখুন। সতর্ক থাকুন এ পবিত্র ভূখ-ের মর্যাদা রক্ষায়। এর মর্যাদা, শিষ্টাচার, পরিচ্ছন্নতা ও পবিত্রতা বহাল রাখুন। সাবধান থাকুন এর শান্তি ও নিরাপত্তা, নিরাপত্তা ও স্থিতি বিঘœকর সব আচরণ থেকে। এটা মাথায় রাখতে হবে যে, হারামাইন-শরিফাইনের পবিত্রতা, হারাম, হাজীরা ও পবিত্র বস্তুগুলোর নিরাপত্তার ব্যাপারটি সবার ওপরে ও সবার আগে। এ ব্যাপারে কোনো শিথিলতা বা বাগাড়ম্বর নেই। এখানে অবকাশ নেই কোনো রাজনৈতিক সেøাগান, বর্ণবাদী, সাম্প্রদায়িক বা গোত্রীয় কোনো আহ্বানের, দলীয় কোন্দল, দ্বন্দ্ব, বিবাদ বা বিসম্বাদের।
এটি বরং ফরজ বিধান। ঈমানি এক যাত্রা। অতএব এতে হজের সময় জায়েজ নয় স্ত্রীর সঙ্গে নিরাভরণ হওয়া। না অশোভন কোনো কাজ করা, না ঝাগড়া-বিবাদ করা। ‘যে আল্লাহর জন্য হজ করল, যৌন সম্পর্কযুক্ত অশ্লীল কাজ ও কথা থেকে বিরত থাকল এবং পাপ কাজ থেকে বিরত থাকল, সে তার মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার দিনের মতো পবিত্র হয়ে ফিরে এলো।’ (আল হাদিস)।
অতএব হাজী সাহেবানের দায়িত্ব হবেÑ আল্লাহর জন্য ইখলাস বাস্তবায়িত করা এবং লোক দেখানো ও লোক সুনামের প্রয়াস থেকে মুক্ত হওয়া। হজের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা উপকারী ইলম আহরণ, হজের বিধিবিধানের জ্ঞানে ব্যুৎপত্তি অর্জন এবং কঠিন বিষয়গুলো আলেমদের কাছে প্রশ্ন করে জেনে নেওয়ার মাধ্যমে। আরও উচিত উন্নত মূল্যবোধ, প্রশংসনীয় আচরণ, মহৎ চরিত্র ও উত্তম আদবে সুসজ্জিত হওয়া। তেমনি এমন সবকিছু থেকে মুক্ত হওয়া, যা আল্লাহ বা তাঁর বান্দাদের সঙ্গে আদব ও আখলাকের পরিপন্থি।
সর্বোপরি আল্লাহর শায়ায়ের ও মাশায়ের তথা পবিত্র স্থান ও নিদর্শনগুলোর ব্যাপারে কোরআনের এ বাণীগুলো মাথায় রাখবেনÑ ‘এটা শ্রবণযোগ্য কেউ আল্লাহর নামযুক্ত বস্তুগুলোর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করলে তা তো তার হৃদয়ের আল্লাহভীতি প্রসূত।’ (সূরা হজ : ৩২)। ‘নিঃসন্দেহে সর্বপ্রথম ঘর, যা মানুষের জন্য নির্ধারিত হয়েছে, সেটাই হচ্ছে এ ঘর, যা মক্কায় অবস্থিত এবং সারা জাহানের মানুষের জন্য হেদায়েত ও বরকতময়। এতে রয়েছে মাকামে ইবরাহিমের মতো প্রকৃষ্ট নিদর্শন। আর যে লোক এর ভেতরে প্রবেশ করেছে, সে নিরাপত্তা লাভ করেছে। আর এ ঘরের হজ করা হলো মানুষের ওপর আল্লাহর প্রাপ্য; যে লোকের সামর্থ্য রয়েছে এ পর্যন্ত পৌঁছার। আর যে লোক তা মানে না, আল্লাহ সারা বিশ্বের কোনো কিছুরই পরোয়া করেন না।’ (সূরা আলে ইমরান : ৯৬-৯৭)।
হে আল্লাহর সম্মানিত ঘরের অতিথিরা, আল্লাহ তায়ালা আমাদের ও আপনাদের কবুল করুন এবং নিজ গুণে ও অনুগ্রহে আপনাদের হজগুলো মাবরুর বানান, চেষ্টাগুলোকে পুরস্কারযোগ্য করুন, গোনাহগুলো ক্ষমা করে দিন।
২৩ জিলকদ ১৪৪০ হিজরি মক্কার মসজিদে হারামে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষিপ্ত
ভাষান্তর আলী হাসান তৈয়ব