৫ খুনের লোমহর্ষক কাহিনী
প্রকাশিত হয়েছে : ১০:০৩:৫৯,অপরাহ্ন ২১ জানুয়ারি ২০১৬ | সংবাদটি ১৪৪৯ বার পঠিত
সম্প্রতি আলোচিত নারায়ণগঞ্জের শহরের বাবুরাইল এলাকার ফ্ল্যাট বাসায় একই পরিবারের পাঁচজনকে হত্যার লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছে হত্যাকারী। বৃহস্পতিবার নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার ড. খন্দকার মহিদউদ্দিন সাংবাদিকদের সেই গল্প শুনিয়েছেন।
তিনি জানান, চার ঘণ্টার মধ্যে পাঁচজনকে হত্যা করে ওই ঘটনায় নিহত তাসলিমার স্বামী শফিকুল ইসলামের ভাগ্নে মাহফুজ। শুধু তাই নয় পাঁচজনকে হত্যা করার পর সেই কক্ষে বসে সিগারেট পান করে সে। হত্যার প্রথম শিকার মোরশেদুল ওরফে মোশারফ ও সর্বশেষ শিকার হয় স্কুলছাত্র মো. শান্ত। এর মধ্যে তাসলিমা, লামিয়া ও সুমাইয়ার মাথায় শিলপাটার শিল দিয়ে আঘাত করে এবং শান্তকে দেয়ালে আঘাত করে হত্যা করে। আঘাতের পর শ্বাসরোধ করে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। আর শিশু সুমাইয়া মারা যায় লামিয়ার ছোড়া শিলের আঘাতে। লামিয়া মাহফুজকে লক্ষ্য করে শিলটি ছুড়লে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে সুমাইয়ার মাথায় লাগে।
বৃহস্পতিবার দুপুর দেড়টায় আদালত সংলগ্ন নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে সংবাদ সম্মেলনে হত্যাকাণ্ডের ওই বর্ণনা তুলে ধরেন জেলা পুলিশ সুপার ড. খন্দকার মহিদউদ্দিন।
এর আগে সকালে নারায়ণগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সাইদুজ্জামান শরীরের আদালতে নিহত তাসলিমার স্বামী শফিকুল ইসলামের ভাগ্নে মাহফুজ ওরফে মারুফ আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়।
নারায়ণগঞ্জ আদালত পুলিশের পরিদর্শক হাবিবুর রহমান জবানবন্দীর সত্যতা স্বীকার করেছেন। অন্যদিকে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবির পরিদর্শক (তদন্ত) আবুল খায়ের জানান, স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে মাহফুজ হত্যাকাণ্ডের কারণ, কখন কীভাবে হত্যা করেছে তার আদ্যোপান্ত বর্ণনা করেছে।
জেলা পুলিশ সুপার ড. খন্দকার মহিদউদ্দিন জানান, পাঁচ খুনে হত্যাকাণ্ডে ছোট ছোট সব আলামত তারা সংগ্রহ করেছেন। এর মধ্যে হত্যাকাণ্ডের পর বাসার দরজায় লাগানো তালার চাবি ওই বাড়ির পানির রিজার্ভ ট্যাংকির ভেতর থেকে উদ্বার করেন। এছাড়াও ওই বাসা থেকে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহার করা শিল উদ্ধার করেন। হত্যাকাণ্ডের সময় অপরাধীর শরীরে যে পোশাক ছিল সেই পোশাক ভেজা অবস্থায় ও বিছানার চাদর বাসা থেকে উদ্ধার করেন।
তিনি আরো জানান, অপরাধী বাসার ভেতরে সয়াবিন তেল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। তারপর নিজেই ওই আগুন নিভিয়েছে বলে তদন্তকারী কর্মকর্তাকে জানান। এসব কিছু জানতে বিভিন্নভাবে তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়। এতে প্রত্যেকটি লাশের মাথা, পা, বিছানার চাদরের অবস্থান সম্পর্কে ভালোভাবে নিশ্চিত হয় তদন্তকারী কর্মকর্তারা।
এছাড়াও পুলিশ সুপার ড. খন্দকার মহিদউদ্দিন নিশ্চিত করেন ওই হত্যা মামলার আসামি মাহফুজ একাই পাঁচজনকে হত্যা করেছেন, যা প্রমাণিত হয়েছে।
হত্যাকাণ্ডটি দুর্ভাগ্যজনক উল্লেখ করে পুলিশ সুপার ড. খন্দকার মহিদউদ্দিন বলেন, তাসলিমার স্বামী শফিকুল ইসলাম এবং শরীফুল ইসলাম দু’জনই শুক্রবার বাসায় থাকার কথা ছিল। আর দু’জন সাধারণত দুই কক্ষে থাকেন। সামনের কক্ষে থাকেন শরীফুল ইসলাম এবং তার স্ত্রী লামিয়া। শরীফ ওইদিন আসেননি, সে কারণে লামিয়া সেই বিছানায় ছিলেন না। তিনি টিভি দেখে রাতের বেলায় পেছনের কক্ষে তার জা’য়ের সঙ্গে দুই সন্তানসহ (শান্ত ও সুমাইয়া) ঘুমাচ্ছিলেন। আর সামনের কক্ষে ঘুমাচ্ছিলেন মোশারফ। মোশারফ তাসলিমার ভাই। মাগরিবের নামাজের আগে আগে তার ভাগ্নে (মাহফুজ) বাসায় ঢুকে খাটের নিচে এক কোনায় ফ্যানের পাশে দীর্ঘক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিল। রাত আড়াইটার দিকে মোশারফ ওয়াশ রুমে যাওয়ার সময় শব্দ হওয়ায় টের পেয়ে যায় অপরাধী। পরে সে (মাহফুজ) একের পর এক মার্ডার করে।
হত্যাকাণ্ডের বিবরণ সম্পর্কে পুলিশ সুপার বলেন, প্রথমে রাত ৩টা বা সোয়া ৩টার মধ্যে রান্নার ঘর থেকে শিল এনে তা দিয়ে ঘুমন্ত অবস্থায় মাথায় আঘাত করে তাসলিমার ভাই মোশারফকে হত্যা করা হয়। পরে ওই কক্ষের সামনে ফজরের আজানের আগে কিংবা পরে দ্বিতীয় মার্ডার করে তাসলিমাকে। তৃতীয় মার্ডার হয় এর কিছুক্ষণ পর লামিয়াকে। লামিয়া চিৎকার করার চেষ্টা করলে শিল দিয়ে আঘাত করে। আঘাতের পর দীর্ঘ সময় বেঁচে ছিলেন লামিয়া। অপরাধী মাহফুজকে প্রতিরোধ করার চেষ্টায় লামিয়া শিল ছুড়ে মারলে শিলটি সুমাইয়ার শরীরে পড়ে। এর মধ্যে একইভাবে লামিয়াকে আঘাত করে হত্যা করে। পরে সুমাইয়াকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। চারজন নিহত হওয়ার পর সর্বশেষ ভিকটিম শান্ত স্কুল থেকে ফিরে দরজায় নক করে। পরে তাকে বাসার ভেতরে দেয়ালে ধাক্কা দিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়।
তিনি আরো বলেন, অপরাধী (মাহফুজ) ১৬ জানুয়ারি হত্যাকাণ্ড শেষে সকাল ৭টা কিংবা ৭টা বিশ মিনিটে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। তবে হত্যাকাণ্ড শুরু হয় ধারণা করা হচ্ছে ১৫ জানুয়ারি ভোর ৫টা চল্লিশ কিংবা ৫টা ৩৫ মিনিটে। আর প্রথম হত্যাকাণ্ডটি শুরু হয় ৩টা থেকে সোয়া ৩টার মধ্যে এবং শেষ হয় সকাল ৭টার মধ্যেই। হত্যাকাণ্ড শেষে বাসায় তালা দিয়ে রিজার্ভ ট্যাংকিতে চাবিটি ছুড়ে ফেলে দিয়ে চলে যায়।
পুলিশ সুপার আরো বলেন, হত্যাকাণ্ডের পর মাহফুজ একটি কারখানার ওয়াশ রুমে ঢুকে হাত, জামা পরিষ্কার করে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে গোসল করে। সিগারেট খায়। ওই কারখানার যে শিশুটি দরজা খোলে সেই শিশুটিকে লালমনিরহাট থেকে নিয়ে আসা হয়।
হত্যাকাণ্ডের প্রধান কারণ সম্পর্কে খন্দকার মহিদউদ্দিন বলেন, ‘এটি অত্যন্ত লজ্জাকর। অপরাধী সুযোগের অপেক্ষায় ছিল রাতের বেলায় শরীফুল থাকবে না, লামিয়া ওই বিছানায় থাকবে; এ ধরনের একটি খারাপ ইচ্ছার সঙ্গে তার সংযোগ করার ইচ্ছা ছিল।’
এসপি আরো জানান, আমরা তদন্ত একেবারেই শেষ করে এনেছি। অচিরেই আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হবে।
এছাড়া সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এইচ এম শফিকুল ইসলামের আদালতে মাহফুজের ছোট ভাই মারুফ, মোরশেদুল ওরফে মোশারফের কারখানার কর্মচারী রাসেল, নয়ন, লাভলু ও নজিমুল ১৬৪ ধারায় সাক্ষ্য স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়। নারায়ণগঞ্জ কোর্ট পুলিশের পরিদর্শক হাবিবুর রহমান এর সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
প্রসঙ্গত, ১৬ জানুয়ারি রাতে বাবুরাইল এলাকা থেকে তাসলিমা, তার ছেলে শান্ত ও মেয়ে সুমাইয়া, ভাই মোরশেদুল ওরফে মোশারফ ও জা লামিয়ার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পরদিন ১৭ জানুয়ারি সকালে নিহত তাসলিমার স্বামী শফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে ভাগ্নে মাহফুজ, ঢাকার কলাবাগানের নাজমা ও শাহজাহানের নাম উল্লেখ করে তাদের সন্দেহ করে সদর থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।
সুত্র্র: বাংলা মেইল