শবেবরাতের ফযীলত সম্পর্কে বর্ণিত সহীহ হাদীস: একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা
প্রকাশিত হয়েছে : ১০:৫৮:৫৪,অপরাহ্ন ২১ মে ২০১৬ | সংবাদটি ২৯২৩ বার পঠিত
মাওলানা আব্দুল আউয়াল হেলাল, লন্ডন থেকেঃ মহিমান্বিত মাহে রাজাব শেষ হবার পথে। সামনে আসছে মাহে শাবান। শাবানের মধ্যবর্তী রাত হচ্ছে একটি বিশেষ ফযীলতপূর্ণ রাত।
বর্তমান সময়ে লা- মাযহাবী চক্র এ রাতের ফযীলত অস্বিকার করে। তাদের দাবী হলো- এ রাতের ফযীলত সম্পর্কে যত হাদীস বর্ণিত হয়েছে সবই موضوع বা বানোয়াট ।
মূলত: তাদের এ দাবী ভিত্তিহীন । শবেবরাতের ফযীলত সম্পর্কে বর্ণিত বহু সংখ্যক হাদীস রয়েছে। তন্মধ্যে একটি হাদীস এবং প্রাসঙ্গিক কিছু কথা পেশ করা হলো।
হাদীস:
عن معاذ بن جبل رضي الله عنه عن النبي صلى الله عليه وسلم قال: يطّلع الله الى خلقه في ليلة النصف من شعبان ، فيغفر لجميع خلقه الا مشرك و مشاحن.
অনুবাদ: মুআয বিন জাবাল রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি ইরশাদ করেছেন যে, শাবানের মধ্যবর্তী রাতে ( শবেবরাতে) আল্লাহ তা’লা তাঁর সৃষ্টি কুলের প্রতি রাহমাতের নজরে তাকান; এবং মুশরিক ও অন্যের প্রতি হিংসা পোষণকারী ছাড়া প্রত্যেককে ক্ষমা করে দেন।
যে সব কিতাবে এ হাদীসটি আছে:
১. ইমাম ইবনু হিব্বান- সহীহ ইবনু হিব্বান (অখন্ড) পৃ: ১৫১৪
২.ইমাম বাইহাকী- ফাদাঈলুল আওকাত পৃ: ১৮
৩. ইমাম তাবারানী- মু’জামুল কাবীর ২০:১০৭, মু’জামুল আওসাত ৭:৩৬
৪.ইমাম সুয়ূতী – দুররুল মানছূর ৫:৭৪১
৫.ইমাম দিমইয়াতি- আল মুত্তাজারুর রাবিহ পৃ: ১৮২
৬.ইমাম আবু আসিম- আসসুন্নাহ পৃ: ৮০
৭.ইমাম মুনযিরী- আত তারগীব ওয়াত তারহীব (অখন্ড) পৃ: ২৪১
৮. ইমাম হাইছামী- মাজমাউয যাওয়ায়িদ ৮:৬৫
৯.ইমাম ইবনু রাজাব হাম্বালী – লাতায়িফুল মা’রিফ পৃ:১৮৮
১০. ইমাম ইবনু আসাকির- তারীখু দিমাশক ৩৮:২৩৫
১১. ইমাম মোল্লা আলী কারী – আত তিবইয়ান পৃ: ১০
১২. ইমাম আবু নাঈম ইস্পাহানি- হিলইয়াতুল আউলিয়া ৫:১৯১
১৩. ইমাম সায়্যিদ আবদুল্লাহ বিন সিদ্দীক গুমারী- হুসনুল বায়ান পৃ:২১
১৪. ইমাম যাকী ইবরাহীম- লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান পৃ: ৭
১৫. ইমাম আবদুল হক দেহলবী- মা ছাবাতা বিসসুন্নাহ পৃ ২০
১৬. ইমাম সায়্যিদ মুহাম্মাদ বিন আলাওয়ী মালিকী আল মাক্কী- ইতমিনানুল কুলূব পৃ: ৬৫
১৭. শায়খ ড. সায়্যিদ মাহমূদ আস সাবিহ- লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান পৃ: ৭২
১৮. শায়খ নাসিরুদ্দিন আলবানী- সিলসিলাতুল আহাদীসিস সাহীহাহ ৩:১৩৫
(উল্লিখিত কিতাবগুলো ছাড়াও লেখকের সংগ্রহে থাকা আরো ১০টি কিতাবে এ হাদীস আছে।)
সনদ পর্যালোচনা :
ক. ইমাম ইবনু হিব্বান রাহিমাহুল্লাহর দৃষ্টিতে এ হাদীস সাহীহ। এ কারণে তিনি নিজ সাহীহ কিতাবে হাদীসটি উল্লেখ করেছেন।
খ. ইমাম হাইছামী নিজ কিতাবে এ হাদীস উল্লেখ করে বলেন- ইমাম তাবারানী বলেছেন যে, এ হাদীসের বর্ণনাকারীগণ সবাই ثقة বা নির্ভরযোগ্য ।( সূত্র: মাজমাউয যাওয়ায়িদ ৮:৬৫)
গ. সালাফী, আহলে হাদীস ইত্যাদি বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে পরিচিত লা-মাযহাবীদের ইমাম শায়খ নাসিরুদ্দিন আলবানী নিজ কিতাব সিলসিলাতুল আহাদীসিস সাহীহায় একটি শিরোনাম করেছেন ما صح في ليلة النصف ( শবেবরাত সম্পর্কে যা সাহীহ) । এই শিরোনামের অধিনে উল্লিখিত হাদীস বর্ণনা করে তিনি হাদীসটির সনদ সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। প্রথমে তিনি বলেছেন- حديث صحيح روي عن جماعة من الصحابة من طرق مختلفة يشد بعضها بعضاً
অর্থাৎ হাদীসটি সাহীহ। সাহাবীগণের একটি জামাত থেকে বিভিন্ন সনদসূত্রে এ হাদীস বর্ণিত হয়েছে; যার একটি অন্যটিকে শক্তিশালী করেছে। ( সূত্র: সিলসিলাতুল আহাদীসিস সাহীহাহ ৩:১৩৬)
দীর্ঘ পর্যালোচনা শেষে তিনি আবারও বলেছেন- و جملة القول ان الحديث بمجموع هذه الطرق صحيح بلا ريب
অর্থাৎ সারকথা হলো বিভিন্ন সনদসূত্রে বর্ণিত এ হাদীসটি নি:সন্দেহে সাহীহ ( সূত্র: সিলসিলাতুল আহাদীসিস সাহীহাহ ৩:১৩৮)
সাহাবী ও তাবিঈগণের অভিমত:
মূলত: কোন বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র প্রমাণিত হাদীস থাকার পর আলাদা ভাবে সাহাবী- তাবিঈন’র অভিমত উল্লেখ না করলেও চলে। তবু পাঠক যাতে আরো বেশি অনুপ্রানিত হন সে বিবেচনায় বিষয়টি উল্লেখ করা হলো।
ইমাম আবদুর রাযযাক সানআনি ( ওফাত: ২১১ হিজরী) নিজ কিতাবে উল্লেখ করেন- عن ابن عمر رضي الله عنهما قال: خمس ليال لا ترد فيهن الدعاء، ليلة الجمعة وأول ليلة من رجب وليلة النصف من شعبان وليلتي العيدين
অর্থাৎ আবদুল্লাহ বিন উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন যে, পাঁচটি রাতে দোয়া ফেরত দেয়া হয় না। সে গুলো হলে- জুমুআর রাত, রাজাব মাসের প্রথম রাত, শাবান মাসের মধ্যবর্তী রাত ( শবেবরাত) এবং দুই ঈদের রাত। ( সূত্র: আল মুসান্নাফ ৪:৩১৭)
ইমাম আলুসী ( ওফাত : ১২৭০ হিজরী) নিজ তাফসীরের কিতাবে সনদ ছাড়াই উল্লেখ করেছেন যে, عن ابن عباس رضي الله عنهما: تقضي الأقضية كلها ليلة النصف من شعبان وتسلم الى أربابها ليلة السابع والعشرون من شهر رمضان
অর্থাৎ আবদুল্লাহ বিন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন যে, শবেবরাতে সব বিষয়ের সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। আর শবেকদরে দায়িত্বশীল ফিরিশতাগণকে তা বুঝিয়ে দেয়া হয়। ( সূত্র: তাফসীর রূহুল মা’নী ২৫:১৩)
তাবিঈগণের মধ্যে হযরত কা’ব আল হিমইয়ারি ( ওফাত:৩২ হিজরী), হযরত আ’তা বিন ইয়াসার ( ওফাত:৯৭ হিজরী), হযরত উমার বিন আবদুল আযীয ( ওফাত: ১০১ হিজরী) ,হযরত খালিদ বিন মা’দান ( ওফাত: ১০৪ হিজরী) , হযরত ইকরিমা (ওফাত:১০৭ হিজরী) এবং হযরত মাকহুল ( ওফাত: ১১৮ হিজরী) প্রমূখ শবেবরাতের ফযীলত বিষয়ে নিজ নিজ অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
ইমাম শাফিঈ (ওফাত: ২০৬ হিজরী) বলেন, ان الدعاء يستجاب في خمس ليال ، في ليلة الجمعة وليلة الاضحي وليلة الفطر وأول ليلة من رجب وليلة النصف من شعبان
অর্থাৎ পাঁচ রাতে দোয়া কবুল হয়। সেগুলো হলো- জুমুআর রাত, ঈদুল আদহার রাত, ঈদুল ফিতরের রাত; রাজাব মাসের প্রথম রাত এবং শাবান মাসের মধ্যবর্তী রাত বা শবেবরাত। ( সূত্র: কিতাবুল উম্ম ১:১৩১)
লা- মাযহাবীদের কাছে শায়খুল ইসলাম এবং যুগের মুজাদ্দিদ হিসেবে বরিত হাফিয ইবনু তাইমিয়্যা ( ওফাত: ৭২৮ হিজরী) বলেন- وأما ليلة النصف: فقد روي في فضلها احاديث وآثار ونقل عن طائفة من السلف كانوا يصلون فيها
অর্থাৎ শবেবরাত বিষয়ে কথা হলো, এ রাতের ফযীলত বিষয়ে অনেক হাদীস এবং আছার বর্ণিত রয়েছে । সলফে সালিহীন থেকে উদ্ধৃত রয়েছে যে, তাঁরা এ রাতে নফল নামায আদায় করতেন।
কয়েকজন তাবিঈ’র অভিমতঃ-
১. হযরত কা’ব আল আহবার রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ( ওফাত: ৩২ হিজরী)
عن كعب قال: ان الله تعالى يبعث ليلة النصف من شعبان جِبْرِيل عليه السلام الى الجنة فيامرها ان تتزين ويقول: ان الله قد أعتق في ليلتك هذه عدد نجوم السماء وعدد ايام الدنيا وليالها وعدد ورق الشجر ووزنة الجبال وعدد الرمال.
( সূত্র: লাতায়িফুল মা’রিফ, পৃ: ২৬৩)
২.হযরত আ’তা বিন ইয়াসার রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ( ওফাত: ৯৭ হিজরী)
عن عطاء بن يسار قال: ما من ليلة بعد ليلة القدر أفضل من ليلة النصف من شعبان ينزل الله تبارك وتعا لى الي السماء الدنيا فيغفر لعباده كلهم الا لمشرك او مشاحن او قاطع رحم.
সূত্র: লাতায়িফুল মা’রিফ, পৃ: ১৯১
৩. হযরত উমার বিন আবদুল আযীয রাহমাতুল্লাহি আলাইহি (ওফাত: ১০১ হিজরী)
عليك بأربع ليال في السنة فان الله يفرغ فيهن الرحمة اول ليلة من رجب وليلة النصف من شعبان وليلة الفطر وليلة النحر.
সূত্র: তালখীসুল হাবীর ২:১৬০, লাতায়িফুল মা’রিফ,পৃ:১৯১
৪.হযরত ইকরিমা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ( ওফাত:১০৭ হিজরী)
عن عكرمة قال: في ليلة النصف من شعبان يبرم فيه امر السنة وتنسخ الاحياء من الأموات ويكتب الحاج فلا يزاد فيهم احد ولا ينقص منهم احد.
সূত্র:তাফসীরে তাবারী ১১:২২২
৬. হযরত খালিদ বিন মা’দান রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ( ওফাত:১০৪ হিজরী)
خمس ليال في السنة من واظب عليهن رجاء ثوابهن وتصديقا بوعدهن ادخله الجنة ،اول ليلة من رجب يقوم ليلها ويصوم نهارها وليلة الفطر وليلة الاضحي وليلة عاشوراء وليلة النصف من شعبان.
সূত্র: তালখীসুল হাবীর ২:১৬০
মাত্র দুই বছর আগেও শুনা যেতো শবেবরাতের ফযীলত সম্পর্কে বর্ণিত সব হাদীস দাঈফ এবং মাউদু বা জাল। সে দিন লন্ডনে একটি টিভিতে একজন আলোচক ( তিনি একটি বিখ্যাত মসজিদের ইমাম) বলেছেন, শবেবরাত ব্যাপারে একটি সহীহ হাদীস আছে। তবে সারা রাত জেগে ইবাদত করা কিংবা সমবেত ভাবে মসজিদে অবস্থান করা যাবে না।
ইমাম ইবনু রাজাব হাম্বালী ( ওফাত: ৭৯৫ হিজরী) বলেন- وليلة النصف من شعبان كان التابعون من أهل الشام كخالد بن معدان ومكحول ولقمان بن عامر يعظمونها ويجتهدون فيها في العبدات
শামের অধিবাসি তাবিঈগণ যথা খালিদ বিন মা’দান, মাকহুল, লুকমান বিন আমির প্রমূখ শবেবরাতকে খুবই তাযীম করতেন এবং সারা রাত নফল ইবাদতে মশগুল থাকতেন। ( সূত্র: লাতায়িফুল মা’রিফ,পৃ:১৯০)
কথা হলো, এই যে তাবিঈগণ শবেবরাতে সারা রাত ইবাদত করতেন তা জেগে থেকে করতেন নাকি ঘুমিয়ে করতেন?
বাকী থাকলো সমবেত ভাবে মসজিদে অবস্থান প্রসঙ্গ । ইমাম ইবনু রাজাব হাম্বালী বলেন- كان خالد بن معدان ولقمان بن عامر وغيرهما يلبسون فيها أحسن ثيابهم ويتبخرون ويكتحلون ويقومون في المساجد ليلتهم تلك
খালিদ বিন মা’দান, লুকমান বিন আমির এবং অন্যান্য তাবিঈগণ শবেবরাতে সুন্দর জামা কাপড় পরতেন, সুগন্ধি জ্বালাতেন এবং চোখে সুরমা লাগিয়ে সারা রাত মসজিদে অবস্থান করতেন। ( সূত্র: লাতায়িফুল মা’রিফ, পৃ:১৯০)
ইমাম বুখারী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির উস্তাদ ইমাম ইসহাক বিন রাহওয়িয়া রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ( ওফাত: ২৩৮ হিজরী ) বলেন- في قيامها في المساجد جماعة ليس ببدعة
শবেবরাতে সম্মিলিত ভাবে মসজিদে অবস্থান করা বিদআত নয়।( সূত্র: লাতায়িফুল মা’রিফ, পৃ: ১৯০)
এবার আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, আমরা তাবিঈগণের দেখানো পথ অনুসরণ করবো নাকি বর্তমান যুগের কোন মোল্লা মৌলভীর পথ?
(শবেবরাত সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আগ্রহী পাঠক অধমের লেখা কুরআন হাদীসের আলোকে শবেবরাত নামক বইখানি পড়তে পারেন।)
লেখকঃ মাওলানা আব্দুল আউয়াল হেলাল, প্রতিষ্টাতা সভাপতি জকিগঞ্জ লেখক পরিষদ।