দারুল ক্বেরাত যেভাবে শুরু করেন আল্লামা ফুলতলী ছাহেব র.
প্রকাশিত হয়েছে : ৩:০৫:০০,অপরাহ্ন ০৬ জুলাই ২০১৬ | সংবাদটি ২৩৭৫ বার পঠিত
হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) ভারতের উত্তর প্রদেশের ঐতিহ্যবাহী রামপুর আলিয়া মাদরাসা থেকে হাদীস, তাফসীর ও ফিকহ বিষয়ে উচ্চ শিক্ষা অর্জন করে বর্তমান ভারতের আসাম রাজ্যের করিমগঞ্জ জেলার বদরপুর আলিয়া মাদরাসায় অধ্যাপনায় নিয়োজিত হন। এ সময় স্বীয় পীর ও মুরশিদ হযরত আবূ ইউসুফ শাহ মোহাম্মদ ইয়াকুব বদরপুরী (র.)-এর নির্দেশে মক্কা শরীফ গমন করে হযরত আহমদ হিজাযী মক্কী (র.)-এর নিকট থেকে ইলমে কিরাতের সনদ লাভ করেন। সেখানে থেকে ফিরে তিনি পুনরায় বদরপুর আলিয়া মাদরাসায় অধ্যাপনা শুরু করেন। একদিন হযরত ছাহেব কিবলাহ (র.) ক্লাসে ছাত্রদের দারস দেওয়ার সময় সেখানে হযরত আবদুন নুর গড়কাপনী (র.) তাশরীফ নিলেন। সমকালীন খ্যাতনামা আলিম ও বুযুর্গ ছিলেন তিনি। ছাহেব কিবলাহ (র.) তাঁকে সমাদরে পাশে বসতে অনুরোধ করে পাঠদানে ব্যস্ত হলেন। ক্লাসের সময় শেষ হলে ছাহেব কিবলাহ (র.) তার কুশলাদি ও আসার কারণ জানতে চাইলে তিনি বললেন, সর্বসাধারণ তো দূরের কথা এতদঞ্চলের অনেক আলিমেরও কিরাত বিশুদ্ধ নয়। তাই ছাহেব কিবলাহ (র.) দারসে কিরাতের জন্য অন্তত সপ্তাহে এক ঘন্টা সময় যেন আমাদের দেন। ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) জবাবে বললেন, আমার হাতে সময় একেবারে কম, বিশেষ করে ক্লাসে ছাত্রদের পাঠদানের আগে নিজে ভালোভাবে তা দেখে নিতে হয়, তাই সময় দেয়া মোটেই সম্ভব নয়। এ কথার পর আবদুন নুর গড়কাপনী (র.) চলে গেলেন।
পরদিন ঠিক একইভাবে উপস্থিত হয়ে একই কথার পুনরাবৃত্তি করলে ছাহেব কিবলাহ (র.) আবারও অপারগতা প্রকাশ করলেন। তখন হযরত আবদুন নুর (র.) বললেন, আমি নিজ থেকে আপনার নিকট আসিনি। বড় জায়গা থেকে নির্দেশ পেয়েই তবে আপনার শরণাপন্ন হয়েছি। ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) তখন স্বীয় মুরশিদ হযরত বদরপুরী (র.)-এর নির্দেশ কিনা জানতে চাইলে হযরত আবদুন নুর (র.) বললেন, না আরো বড় জায়গা থেকে নির্দেশ পেয়েছি। ছাহেব কিবলাহর অনুরোধে তিনি বর্ণনা করলেন, ‘আমি স্বপ্নে হুযূর (সা.)-এর দিদার লাভ করি। আমি হুযূর (সা.)-এর কন্ঠে সুললিত তিলাওয়াতে কালামে পাক শুনতে পাই। আরয করলাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ (সা.)! এই কিরাত কিভাবে শিখব? তখন নবী পাক (সা.) ডান দিকে যাকে দেখিয়ে ইশারা করলেন, চেয়ে দেখি সেই সৌভাগ্যবান আপনি।’ একথা শুনার সাথে সাথে হযরত ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) কেঁদে ফেললেন এবং তাঁকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ঠিক আছে আমি সপ্তাহের প্রতি বৃহস্পতিবার ১২টার পরে নিকটবর্তী হযরত আদম খাকী (র.) (তিনশত ষাট আউলিয়ার অন্যতম)-এর মাজার সংলগ্ন মসজিদে কিরাতের র্দাস দেওয়ার ওয়াদা দিলাম।
এভাবেই ১৯৪৬ ইং সালে ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর ইলমে কিরাতের খিদমতের সূত্রপাত। বদরপুর থেকে আদম খাকী (র.)-এর মাযার প্রায় দুই মাইল দূরে। এ পথ পায়ে হেঁটে গেলে কষ্ট হবে বিবেচনায় হযরত আবদুন নুর (র.) সহ শাগরিদগণ ছাহেব কিবলাহর জন্য একটি ঘোড়া ক্রয় করেন। এরপর থেকে হযরত ছাহেব কিবলাহ (র.) বিভিন্ন অঞ্চলে পায়ে হেঁটে, ঘোড়ায় চড়ে দীর্ঘপথ অতিক্রম করে অবৈতনিকভাবে ইলমে কিরাতের র্দাস দিয়েছেন। যখনই যে অঞ্চলে যেতেন স্থানীয় উলামা–মুদাররিসীন কিরাত শিক্ষার জন্য জমায়েত হয়ে যেতেন। ছাহেব কিবলাহ (র.) ধৈর্য সহকারে তাদের মশক দিতেন। ফলে সিলেট ও আসাম অঞ্চলের খ্যাতনামা আলিমগণ তাঁর নিকট থেকে বিশুদ্ধ কিরাত শিক্ষা করে উপকৃত হয়েছেন। পবিত্র কালামের শিক্ষা বিস্তারে তাঁর ত্যাগ ও কর্মের বিশালতার কথা প্রত্যন্ত অঞ্চলে কিংবদন্তীর মতো ছড়িয়ে আছে।
বোর্ড গঠন ও প্রসারতা লাভ
১৯৫০ ঈসায়ী সনে ছাহেব কিবলাহ (র.) নিজ বাড়িতে ইলমে কিরাতের দারস প্রথম চালু করেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ছাত্র ও শিক্ষকদের সুবিধার্থে ছুটির অবসরকালীন রামাদ্বান মাসকে কিরাত শিক্ষার জন্য বেছে নেয়া হয়। উপরন্তু রামাদ্বান হলো নুযুলে কুরআনের মাস। প্রতি বৎসর রামাদ্বানে ছাহেব কিবলাহ (র.) নিজ বাড়িতে শিক্ষার্থী আলিমদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা নিজ খরচে বহন করতেন। পঞ্চাশ হতে একশত এভাবে দিন দিন শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। সকলকে তা’লীম দিয়ে এবং সমগ্র কুরআন শরীফ নিজে শুনে প্রয়োজনীয় সংশোধনী করে তবেই তিনি সনদ প্রদান করতেন। পরবর্তীতে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকায় অন্যান্য স্থানে শাখা কেন্দ্র অনুমোদন ও একটি বোর্ড গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় এবং ৭ সদস্য বিশিষ্ট ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করা হয়। বোর্ডের সদস্যদের অনুরোধক্রমে ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর ওয়ালিদ মুহতারাম হযরত মুফতী মাওলানা আব্দুল মজীদ চৌধুরী (র.)-এর নামানুসারে এই প্রতিষ্ঠানের নাম রাখা হয় ‘দারুল কিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাস্ট’। হযরত ছাহেব কিবলাহ (র.) আজীবন এ বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। ট্রাস্টি বোর্ডের অধীনে কেন্দ্রীয় দপ্তর বা বোর্ড অফিস ফুলতলী ছাহেব বাড়ি থেকেই বাংলাদেশ ও বহির্বিশ্বে কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। নিজস্ব বিল্ডিং থেকে বছরব্যাপী এর প্রস্তুতি চলে থাকে। বোর্ডের জেনারেল সেক্রেটারী হিসেবে দক্ষতা ও আন্তরিকতার সাথে অবৈতনিকভাবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন বড় ছাহেবজাদা হযরত আল্লামা মোহাম্মদ ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী (বড় ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী)। প্রথম পর্যায়ে এ ঐতিহাসিক খিদমতে যারা ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর সাথে থেকে কিরাত শিক্ষা গ্রহণ করে পরিচালনার কোনো কোনো ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন– হযরত মাওলানা শাতির আলী গর্দীশপুরী (র.), মরহুম দেওয়ান আবদুল বাছির (র.), হযরত মাওলানা কারী আবদুল লতিফ খাদিমানী (র.)। ছাহেব কিবলাহ (র.) শুরুর দিকেই তাঁর ভূ–সম্পত্তির বিশাল অংশ (প্রায় ৩৩ একর) এ ট্রাস্টের নামে ওয়াকফ করে দিয়েছিলেন। বর্তমানে এ বোর্ডের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রায় দুই হাজার শাখা কেন্দ্র দেশ–বিদেশে ছড়িয়ে রয়েছে। প্রতি বছর এ সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। শাখা অনুমোদন, নবায়ন, শিক্ষক নিয়োগ, প্রশ্নপত্র সরবরাহ, পরীক্ষা গ্রহণ, হিসাব নিরীক্ষণ ইত্যাদি সকল কার্যক্রম বোর্ড থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়ে থাকে। ছাহেব কিবলাহ (র.) প্রণীত ‘আল কাউলুছ ছাদীদ’ এবং বড় ছাহেবজাদা হযরত আল্লামা ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী ফুলতলী রচিত ‘প্রাথমিক তাজবীদ শিক্ষা’ কিতাব দুটি বোর্ড অনুমোদিত ইলমে তাজবীদের পাঠ্য হিসেবে দারুল কিরাতে পড়ানো হয়। এ বোর্ডের অধীনে সর্বমোট ৬টি ক্লাসের মাধ্যমে সমস্ত কুরআন শরীফ সহীহ শুদ্ধভাবে তিলাওয়াতের পদ্ধতি শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে।
প্রধান কেন্দ্র
দারুল কিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাস্ট–এর প্রধান কেন্দ্র ফুলতলী ছাহেব বাড়িতে অবস্থিত। বোর্ডের মাধ্যমে বিভিন্ন স্থানে শাখাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হলেও শেষ জামাত (ছাদিছ) কেবলমাত্র প্রধান কেন্দ্রেই রয়েছে। শেষ জামাত আর কোথাও নেই বলে হাজার হাজার ছাত্র প্রতি বছর রামাদ্বান মাসব্যাপী প্রধান কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে থাকেন। হযরত ছাহেব কিবলাহ (র.) শুরু থেকে জীবনের শেষ বছর পর্যন্ত প্রধান কেন্দ্রে ইলমে কিরাতের র্দ্সা প্রদান করেছেন। শেষ কয়েকটি বছর শারীরিকভাবে অত্যন্ত দুর্বল থাকা স্বত্বেও তিনি এ খিদমত থেকে বিরত হননি। পাশাপাশি তাঁর নিকট থেকে সনদপ্রাপ্ত তাঁর সাতজন ছাহেবজাদাসহ অর্ধশতাধিক শিক্ষক এখানে নিয়মিত শিক্ষা প্রদান করে আসছেন। ছাহেব কিবলাহ (র.) সারাজীবন অবৈতনিকভাবে কিরাতের খিদমত আঞ্জাম দিয়েছেন। ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর নিকট সনদপ্রাপ্ত তাঁর ছাহেবজাদা ও নাতিগণও অবৈতনিকভাবে এ খিদমত আন্জাম দিচ্ছেন। মাসব্যাপী সকল ছাত্র ও শিক্ষকবৃন্দের থাকা খাওয়ার খরচ ছাহেব কিবলাহ (র.) তাঁর ব্যক্তিগত তহবিল থেকে নির্বাহ করতেন। এখনও তাঁর সম্পত্তি থেকে ছাহেবজাদাগণ তা নির্বাহ করে থাকেন। শিক্ষার্থীদের নিকট থেকে সামান্য ভর্তি ফি গ্রহণ করা হয়ে থাকে, যা দিয়ে শিক্ষকবৃন্দের যাতায়াত সম্মানী, স্টাফ ও কর্মচারী বেতন এবং অফিস খরচ নির্বাহ করা হয়ে থাকে। এ প্রতিষ্ঠান থেকে এ যাবত লক্ষাধিক লোক বিশুদ্ধ কিরাত শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। হযরত ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর এ খিদমত এবং তাঁর এ প্রতিষ্ঠানকে আল্লাহ পাক কিয়ামত পযন্ত স্থায়ী রাখুন এবং তাঁর পরিবার–পরিজন ও আবাসকে আল কুরআনুল কারীমের আলো দিয়ে আলোকিত রাখুন।