সড়ক নিরাপত্তা: নতুন সড়ক পরিবহন আইনে কী আছে, পক্ষে বিপক্ষে যতো কথা
প্রকাশিত হয়েছে : ৭:৩৯:১৭,অপরাহ্ন ০৩ নভেম্বর ২০১৯ | সংবাদটি ৩১৩ বার পঠিত
বাংলাদেশে চালক ও পথচারী উভয়ের জন্য কঠোর বিধান যুক্ত করে শুক্রবার থেকে কার্যকর করা হয়েছে বহুল আলোচিত ‘সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮।’
গত বছর ঢাকার দুই কলেজ শিক্ষার্থী সড়কে বাস চাপায় প্রাণ হারানোর পর শিক্ষার্থীদের ব্যাপক আন্দোলনের মুখে ১৯শে সেপ্টেম্বর সড়ক পরিবহন আইন পাস করে সরকার। ১৪ মাস পর সেটা কার্যকর হল।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী আসমা আক্তার সেলিনা মনে করেন, নতুন এই আইনের ফলে মানুষ আগের চাইতে বেশি সচেতন হবে।
“আমাদের এখানে প্রতিদিন এতো অ্যাকসিডেন্ট হয়, তারপরও কোন চেঞ্জ নাই। কে কার আগে যাবে প্রতিযোগিতা করতে থাকে। মারা যায় ওই সাধারণ মানুষ। আবার পথচারীরাও ইচ্ছামতো রাস্তা পার হয়ে যাচ্ছে। এই দুইটাই বন্ধ হওয়া উচিত। নতুন আইনে শাস্তি বাড়ানোয় মানুষ এখন আগের চাইতে ভয় পাবে, সাবধান হবে।” বলেন মিস সেলিনা।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেন এই আইন প্রয়োগে তৎপর থাকে সে ব্যাপারে নজর দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন উম্মে সালমা সাথি।
তিনি বলেন, “আইন তো অনেক আছে, কিন্তু সেটা বাস্তবায়ন হয় কিনা সেটা নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য পুলিশকে অ্যাকটিভ হতে হবে। বিদেশে দেখেন রাস্তায় এতো মানুষ, এতো গাড়ি-কেউ কিন্তু আইন ভাঙে না, কারণ পুলিশ অনেক টাকা জরিমানা করে। আসলে ভয় দেখানোর মতো আইন প্রয়োগ করলে শৃঙ্খলা আপনা আপনি আসবে।”
নতুন আইনের উল্লেখযোগ্য ১৪টি বিধান:
- সড়কে গাড়ি চালিয়ে উদ্দেশ্য প্রনোদিতভাবে হত্যা করলে ৩০২ অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
- সড়কে বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালালে বা প্রতিযোগিতা করার ফলে দুর্ঘটনা ঘটলে তিন বছরের কারাদণ্ড অথবা তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। আদালত অর্থদণ্ডের সম্পূর্ণ বা অংশবিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে দেয়ার নির্দেশ দিতে পারবে।
- মোটরযান দুর্ঘটনায় কোন ব্যক্তি গুরুতর আহত বা প্রাণহানি হলে চালকের শাস্তি দেয়া হয়েছে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের জেল ও সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা।
- ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া মোটরযান বা গণপরিবহন চালানোর দায়ে ছয় মাসের জেল বা ২৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড দেয়া হয়েছে।
- নিবন্ধন ছাড়া মোটরযান চালালে ছয় মাসের কারাদণ্ড এবং পঞ্চাশ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রয়েছে।
- ভুয়া রেজিস্ট্রেশন নম্বর ব্যবহার এবং প্রদর্শন করলে ছয় মাস থেকে দুই বছরের কারাদণ্ড অথবা এক লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দেয়া হয়েছে।
- ফিটনেসবিহীন ঝুঁকিপূর্ণ মোটরযান চালালে ছয় মাসের কারাদণ্ড বা ২৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড দেয়া হয়েছে।
- ট্রাফিক সংকেত মেনে না চললে এক মাসের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড দণ্ডিত করা হবে।
- সঠিক স্থানে মোটর যান পার্কিং না করলে বা নির্ধারিত স্থানে যাত্রী বা পণ্য ওঠানামা না করলে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে।
- গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোনে কথা বললে এক মাসের কারাদণ্ড এবং ২৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।
- একজন চালক প্রতিবার আইন অমান্য করলে তার পয়েন্ট বিয়োগ হবে এবং এক পর্যায়ে লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাবে।
- গণ পরিবহনে নির্ধারিত ভাড়ার চাইতে অতিরিক্ত ভাড়া, দাবী বা আদায় করলে এক মাসের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড দণ্ডিত করা হবে।
- আইন অনুযায়ী ড্রাইভিং লাইসেন্সে পেতে হলে চালককে অষ্টম শ্রেনি পাস এবং চালকের সহকারীকে পঞ্চম শ্রেণি পাস হতে হবে হবে। আগে শিক্ষাগত যোগ্যতার কোন প্রয়োজন ছিল না।
- গাড়ি চালানোর জন্য বয়স অন্তত ১৮ বছর হতে হবে। এই বিধান আগেও ছিল।
এছাড়া সংরক্ষিত আসনে অন্য কোনও যাত্রী বসলে এক মাসের কারাদণ্ড, অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
শাস্তি বাড়ানোর বিরোধিতা
সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর নামে পরিবহন শ্রমিকদের বিরুদ্ধে শাস্তি বাড়ানোর বিরোধিতা করেছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান।
শ্রমিকদের জন্য নতুন এই আইন নমনীয় করার দাবি জানান তিনি।
মি. খান বিবিসি বাংলাকে বলেন, “যদি সব মামলায় ৩০২ ধারা (মৃত্যুদণ্ড) রাখা হয়, ড্রাইভারকে যদি যাবজ্জীবন সাজা দেয়া হয় ওই চালকের গরিব পরিবারের কী অবস্থা হবে? তাছাড়া আমাদের দেশে এমনিতেই লাখ লাখ ড্রাইভার কম আছে। জামিনযোগ্য শাস্তি না হলে ড্রাইভারের সংকট আরও বাড়বে। এই বিষয়গুলো বিবেচনা করা দরকার।”
“আইন কার্যকর করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে শ্রমিকদের যেন হয়রানি হতে না হয়।”
মন্দের ভালো আইন
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন গড়ে ৫৫ ব্যক্তির প্রাণহানি হচ্ছে।
আর বাংলাদেশ রিসার্চ ইন্সটিটিউটের গবেষণা বলছে, দেশে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় গড়ে ১২,০০০ মানুষ নিহত ও ৩৫,০০০ আহত হন।
এই পটভূমিতে নতুন এই আইন সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে বড় ধরণের ভূমিকা রাখবে বলে জানান যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী।
তবে আইনটি আরও যাত্রীবান্ধব হওয়া প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
“আমাদের দেশ দীর্ঘদিন যাবত যেখানে আইনের শাসন অনুপস্থিত ছিল। সেখানে এই আইনে অপরাধ ও দণ্ডের পরিমাণটা যুগোপযোগী করা হয়েছে। তবে যাত্রী স্বার্থে দিকটা এখানে নজরে আনা হয়নি। তাই বলবো মন্দের ভাল আইন হয়েছে”
“এই আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত করা গেলে এই আইনটি সড়ক পরিবহনে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হতে পারে।” বলেন মি. চৌধুরী।
মামলার দীর্ঘসূত্রিতা
মামলা দায়ের থেকে শুরু করে নিষ্পত্তি পর্যন্ত দীর্ঘসূত্রিতা এবং সাক্ষ্য গ্রহণে জটিলতা মীমাংসা করা না গেলে আইনের সুফল থেকে সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হবে বলে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সীমা জামান।
“একটা মামলায় জাজমেন্ট হয়, আপিল হয়, রিভিউ হয়। সব মিলিয়ে অনেক সময় লেগে যায়। ততদিনে ঘটনার ইমপ্যাক্টটা সেভাবে থাকে না,” তিনি বলছেন, “এছাড়া সড়ক দুর্ঘটনায় সাক্ষ্য গ্রহণ নিশ্চিত করা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। পুলিশি তৎপরতারও একটা ব্যাপার আছে।”
“এখন সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে যদি একটা ট্রাইব্যুনাল থাকতো। তদন্ত কর্মকর্তারা যদি চাপে থাকতেন যে দ্রুত প্রতিবেদন জমা দিতে হবে, তাহলে সাধারণ মানুষ এই আইনের সুফলটা পেতো।”