কাঁদো আর্জেন্টিনা, কাঁদো
প্রকাশিত হয়েছে : ৭:৫২:০০,অপরাহ্ন ২৭ জুন ২০১৬ | সংবাদটি ২২১৩ বার পঠিত
‘কষ্টের গায়ে লাল জামা, বেদনার গায়ে নীল।’ আসলেই কি তাই। নাকি বেদনার রং আকাশী ও সাদাও।বৈশ্বিক ও মহাদেশীয় মিলে পাঁচটি ফাইনাল, পাঁচবারই রানার্স আপ। পাঁচবারই হতাশা আর কান্না সঙ্গী। মরণদূত হিসাবে সামনে হাজির হয়েছে জার্মানি, ব্রাজিল ও চিলি। স্বপ্নভঙ্গের বেদনা, সঙ্গে অঝোর ধারায় কান্না। একটি ট্রফি উঁচিয়ে ধরার আক্ষেপে যতবার অশ্রু ঝড়েছে আর্জেন্টিনার, তেমনটি আর কোন দলের হয়তো নেই্। আশা ছিল ২৩ বছরের অপেক্ষার অবসান হবে। হলো আর কই। দীর্ঘশ্বাস যেন আরও বেড়ে গেল। মেসির স্বপ্নপূরণ রূপ নিল কান্নায়। মেটলাইফ গ্যালারীতে মায়ের কোলে বসা ছোট্ট শিশুর চোখেও জল। যে দৃশ্য আর্জেন্টাইন ভক্তদের হৃদয় যেন আরও দুমড়ে মুচড়ে দিল।
১৯৯০ বিশ্বকাপের ফাইনালে কেঁদেছিলেন ম্যারাডোনা। পশ্চিম জার্মানির কাছে হেরে। শেষ বৈশ্বিক শিরোপা সেই ম্যারাডোনার হাত ধরেই ১৯৮৬ বিশ্বকাপে। ১৯৯১ ও ১৯৯৩ সালে দুটি কোপা শিরোপা জিতিয়ে ম্যারাডোনার দুঃখ কিছুটা ভুলিয়েছিলেন গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা। কিন্তু মেসির দুঃখ ভোলাবে কে? টানা তিন ফাইনাল, বিশ্বকাপ, কোপা, শতবর্ষী কোপা। ২০১৪, ১৫ ও ১৬। প্রথমে জার্মানি, পরের দুইবারই চিলি। আহা, এই দুঃস্বপ্ন না জানি কতদিন তাড়িয়ে বেড়ায় মেসিকে।
গোটা টুর্নামেন্টেই যোগ্য নায়ক হিসাবে পথচলা। সেটা প্রতিটি টুর্নামেন্টেই। সদ্য শেষ হওয়া শতবর্ষী কোপাতেও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোল তার (৫টি)। হ্যাটট্রিকও করেছেন। তবে বরাবরের মতো ফাইনাল দুঃখটাই প্রকট আকার ধারণ করল। ব্রাজিল বিশ্বকাপের ফাইনাল, ২০১৫ কোপা ফাইনালের মতো এবারও আরেকটি ফাইনালে মেসি থাকলেন নিজের ছায়া হয়ে। ফাইনালে গোল না করতে পারার দুঃখ মেসিকে যেন কুড়ে কুড়ে খেল অনেকটা সময়। ফাইনালের ট্রাজিক হিরো যেন মেসিই।
গ্রুপ পর্বে এই চিলিকেই ২-১ গোলে পরাস্ত করেছিল আর্জেন্টিনা। যে ম্যাচে মেসি খেলেননি।কিন্তু ফাইনালে সেই চিলি আর্জেন্টিনার জন্য দুঃস্বপ্নের নাম। পুনর্মঞ্চায়ন হলো যেন, ২০১৫ কোপার ফাইনাল। উন্মত্ত উল্লম্ফনে ব্যস্ত ব্রাভো শিবির, হতাশায় ভারে সুনসান নীরবতা মার্টিনো শিবিরে। নীরবে শুধু অশ্রুই ঝড়ল।
এবারের ফাইনাল হারের জন্য অনেকেই দায়ী করছেন মেসিকেই। যিনি টাইব্রেকার নামক টসভাগ্যে শুরুটা ভালো করতে পারেননি দলের হয়ে। অথচ গোলরক্ষক রোমেরো ঠিকই আরতুর ভিদালের প্রথম শট প্রতিহত করে আর্জেন্টিনার শিরোপা স্বপ্ন উজ্জ্বল করেছিল। কিন্তু প্রথম শটেই মেসি বুঝিয়ে দিলেন ট্রফি উচিয়ে ধরার ভাগ্য হয়তো নেই আর্জেন্টিনার। সেমিফাইনালে ২৫ গজ দূর থেকে কি নয়নকাড়া ফ্রি কিকে গোল করেছিলেন মেসি। মানব দেয়াল টপকে বল কোনাকুনি ভাবে আশ্রয় নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের জালে।
অথচ সেই মেসি, সামনে শুধু গোলরক্ষককে পেয়েও মারলেন পোস্টের বাইরের দিকে। চিলি গোলরক্ষক ব্রাভোকে ঠিকই ডজ দিতে পেরেছিলেন মেসি। ব্রাভো ঝাঁপিয়েছিলেন বা দিকে। মেসির বল গিয়েছিল ডান দিকে। একটুর জন্য বল জড়ায়নি জালে। হতাশ মেসি মুখ ঢাকলেন নিজের জার্সিতে। শিরোপা আশা যেন ঐখাবেই শেষ। সতীর্থদের কাছে মেসি যেন যেতেই পারছিলেন না। পা দুটি যেন ভারি হয়ে আসছিল। সোনালি দাঁড়িতে বিষণ্ন-বিধ্বস্ত এক মেসি। কে বলবে, এই মেসিই বার্সার রেকর্ডের বরপুত্র, জিতেছেন রেকর্ড পাঁচবার ফিফা বর্ষসেরা ফুটবলরের খেতাব। শুধু আসল না জাতীয় দলের হয়ে একটি বড় ট্রফিই।
ব্রাজিল বিশ্বকাপের ফাইনালে ১২০ মিনিটের লড়াইয়ে শেষের দিকে মারিও গোটশের গোলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল জার্মানি। শেষের দিকে একটি ফ্রি কিক পেয়েছিল আর্জেন্টিনা। যেখান থেকে হরহামেশাই গোল পেয়ে থাকেন মেসি। কিন্তু মেসির শট বারপোস্টের এত উপর দিয়ে গেল যে, তা কল্পনা করাও কষ্টের। দুই বছর পর কোপার ফাইনালেও মেসির শট আশ্রয় নিল গ্যালারীতে। তাহলে মেসি কি ফাইনালের চাপ নিতে পারেন না? তার সঙ্গে গোটা দলই কি ফাইনাল ভীতিতে জড়সড়ো? টানা তিন ফাইনাল হেরে যাওয়ার পর, তা মেনে নিতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়, আর্জেন্টিনার। ক্রিকেটে চোকার বলা হয় দক্ষিণ আফ্রিকাকে। ফুটবলে ফাইনালের চোকার আর্জেন্টিনা, তাতে অবশ্য কারো দ্বিমত থাকার কথা নয়।
টাইব্রেকারে কিছুক্ষণ আগেই বিগলিয়ার শট রুখে দিয়েছে চিলির গোলরক্ষক অধিনায়ক ক্লদিও ব্রাভো। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আনন্দে (৪-২) উৎসবে মাতোয়ারা তখন গোটা চিলি শিবির। চলছে গগন বিদারী চিৎকার আর মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের গৌরবমাখা উদযাপন। ঠিক তখনো বিক্ষিপ্তভাবে মাঠের মধ্যে আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়রা। শূন্য দৃষ্টিতে ভাবলেশহীন সবাই। মাঠের মধ্যে অনেকক্ষণ মেসি বসে থাকলেন দুই হাত হাটুর উপর রেখে। একসময় দুই পা টেনে বসলেন রিজার্ভ বেঞ্চে। চোখ দুটো ছলছল। বেদনা ভঙ্গের কষ্টে কয়েকফোটা অশ্রুও ঝড়ে পড়ল। গ্যালারীতে তখনও সমর্থকদের বুক ফাটা আর্তনাদ। এ কান্নার শেষ কোথায়। জানে না কেউ।