ভূমিকম্পের চরম আতঙ্কে বাংলাদেশ
প্রকাশিত হয়েছে : ৯:১৮:৪৩,অপরাহ্ন ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ | সংবাদটি ১৭৫৪ বার পঠিত

চৌত্রিশ সালের পর থেকে দীর্ঘদিন যাবত হিমালয়ের পাদদেশে আটকা পড়ে আছে, অপেক্ষা করছে বড় ধরনের নড়াচড়া বা ভূমিকম্পের।
ভূ-বিজ্ঞানীগণ মনে করেন, ভূ-গর্ভস্থ টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষ, আগ্নেয়গিরি ও মানবসৃষ্ট কারণে পৃথিবীতে ভূমিকম্প হয়ে থাকে। ভূ-ত্বক কতগুলো প্লেটে বিভক্ত, এগুলোকে বলে টেকটোনিক প্লেট। আর বাংলাদেশ অবস্থান করছে তিনটি টেকটোনিক প্লেটের মাঝখানে। এগুলো হল ভারতীয়, ইউরেশিয় ও মায়ানমার টেকটোনিক প্লেট। তারা আরো মনে করেন, বাংলাদেশের উত্তরে অবস্থান করছে যে ইন্দো-অস্ট্রেলীয় প্লেট, সেটি প্রতি বছর ৪৫ মিলিমিটার করে ইউরেশিয় প্লেটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।আর তাই যতই দিন যাচ্ছে ততোই বাংলাদেশে বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশ শুধু ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলেই অবস্থিত নয়;বরংবিশ্ব জরিপেও ঢাকা ভূমিকম্পের লিস্টে স্থান দখল করে নিয়েছেউনিশশো নিরানব্বই সালে জাতি- সংঘের অধীনে রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট টুলস ফর ডায়াগনসিস অব আরবান এরিয়াস এগেইনস্ট সিসমিক ডিজাস্টার। এই জরিপ পরিচালিত হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের রজার বিল হাম তার গবেষণায় বলেছিলেন, হিমালয়ের পাদদেশে মেইন বাউন্ডারি ট্রাস্ট (এমবিটি) রয়েছে, যা বাংলাদেশ থেকে চারশত কিলোমিটার উত্তরে। এখানে ইউরেশিয়া প্লেটের নিচে ভারতের যে প্লেটটি তলিয়ে যাচ্ছে, সেটি লক হয়ে আছে। এটি খুলে গেলেই বাংলাদেশ, ভুটান ও নেপালে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে।বাংলাদেশে শনিবারের ভয়াবহ ভূমিকম্পের কারণে তাঁর সেই আশংকা বাস্তব রূপ নিচ্ছে বলেই মনে হয়।দুই হাজার পাঁচ সালে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে ওয়াশিংটনে একটি বার্তা পাঠিয়েছিল ঢাকার মার্কিন দূতাবাস। তাতে বলা হয়, আগামী দশ বছরের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে আট বা তারও বেশি তীব্রতার ভূমিকম্প হতে পারে। তাও আবার একটি-দুটি নয়, এ ধরনের অন্তত সাতটি ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে।
দুই হাজার পাঁচ সালের সাতাশ এপ্রিল ওই তারবার্তাটি পাঠান ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স জুডিথ চামাস।কিন্তু কোন কিছুতেই যেন আমাদের টনক নড়ছে না।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংবিভাগের অধ্যাপক ড.মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বছর দেড়েক আগে আমাদের একটি গবেষণা শেষ হয়েছে।সেখানে আমরা দেখিয়েছি রিখটার স্কেলে সাত দশমিক পাঁচ থেকে সাত দশমিক নয় মাত্রায় বাংলাদেশে ভূমিকম্প হলে শুধু রাজধানীতেই আড়াই লাখ লোক মারা যেতে পারে।চার শতাধিক ভবন মাটির সঙ্গে মিশে যেতে পারে নেপালে যেটা ঘটেছে আমাদের অবস্থা হতে পারে তার চেয়েও ভয়াবহ।তিনি আরও বলেন, বুয়েটে আমাদের যে ব্যবস্থা আছে তাতে দেখা যাচ্ছে পঁচিশ এপ্রিলে বাংলাদেশে ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে চার থেকে পাঁচ এর মধ্যে।
বাংলাদেশ ভূমিকম্প সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. মুনতাজ আহমেদ নূর বলেন,বাংলাদেশ খুব নাজুক অবস্থায় রয়েছে। দেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলো ভূমিকম্পের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হলেও অপরি-কল্পিত নগরায়ণের জন্য ঢাকা ও চট্রগামও রয়েছে বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে।
ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ড.মাকসুদ কামাল জানান,ভূতাত্তি্ক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ ভূমিকম্প দুর্যোগের জন্য ঝুঁকিপ্রবণ।ভূমিকম্প সাধারণত সংঘটিত হয় ভূতাত্তি্ক প্লেট বাউন্ডারি কিংবা ফাটলরেখা বরাবর।বাংলাদেশের পূর্ব সীমান্তে রয়েছে ভারত ও বার্মিজ খণ্ডিত প্লেটের বাউন্ডারি এবং দেশের অভ্যন্তরে শক্তিশালী ভূমিকম্প সৃষ্টি করার মতো রয়েছে তিনটি ফাটলরেখা।দেশের মধ্যবর্তী অঞ্চলে রয়েছে প্রায় ষাট কিলোমিটার দীর্ঘ মধুপুর ফাটলরেখা। ভারতের উত্তর-পূর্ব মেঘালয় অঞ্চল ও বাংলাদেশের সিলেট,ময়মনসিংহ সীমান্ত অঞ্চলে রয়েছে প্রায় দুইশত ত্রিশ কিলোমিটার দীর্ঘ ডাউকি ফাটলরেখা। আবার দেশের পূর্ব প্রান্তে বাংলাদেশ, ভারত এবংমিয়ানমার সীমান্ত বরাবর রয়েছে প্রায় এক হাজার ছয়শত কিলোমিটার লম্বা পূর্বাঞ্চলীয় সুদীর্ঘ ফাটলরেখা,যা আন্দামান নিকোবর থেকে শুরু করে হিমালয়ের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত।গত একশত পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশে সাত টি বড় আকারের ভূমিকম্প হয়েছে।এর মধ্যে দুটির কেন্দ্র ছিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরে।এর পরও আমাদের দেশের সরকার ও অন্যান্য উর্দুতন কর্মকর্তা এ ব্যাপারে চোখে পড়ার মত কোন পদক্ষেপ নিচ্ছেন না বিধায় বাংলাদেশের মানুষ খুবই আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন।
আমাদের মনে রাখা উচিত উনিশশো আঠারো সালের আট জুলাই ৭.৬ মাত্রার সেই ভূমিকম্পের কেন্দ্র ছিল সিলেটের শ্রীমঙ্গলে।আর আঠারোশো পচাশি সালের চৌদ জুলাই একই মাত্রার ভূমিকম্প হয়,যার কেন্দ্র ছিল মানিকগঞ্জে। আরও কয়েকটি ভূমিকম্প বাংলাদেশের কেন্দ্রে না হলেও রেখে গেছে ধ্বংসের চিহ্ন।এগুলোও আমাদের স্বরণ করা দরকার বলে আমি মনে করি।আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক শাহ আলম জানান,শনিবারের ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল বাংলাদেশ থেকে সাতশত পয়তাল্লিশ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে,তাই বাংলাদেশে এর প্রভাব পড়তে পড়তে খানিকটা দুর্বল হয়ে পড়েছিল বাংলাদেশের ভাগ্যবান মানুষের জন্য।তবে যে কোনো সময় বাংলাদেশে বড় ধরনের ভূমিকম্প হতে পারে।তাই তিনিও এ ব্যাপারে সকলকে সচেতন থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।এতোকিছু হয়ে যাচ্ছে বা ঘটে যাচ্ছে,কিন্তু দুঃখ জনক হলেও সত্য যে,এ ব্যাপারে আমাদের সরকারের পক্ষ থেকে সুদূর প্রসারি কোন পদক্ষেপ বাংলাদেশের মানুষ দেখতে পায় নি।অচিরেই এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়ার জোর দাবি
জানাচ্ছে বাংলাদেশের মানুষ।
বিশেষজ্ঞরা আরো জানিয়েছেন, রাজধানী ঢাকার ৬৫ শতাংশ এলাকা ভবন নির্মাণের উপযোগী নয়। তারপরও ঝুঁকি নিয়েই সেসব এলাকায় বহুতল ভবন গড়ে উঠছে।বিশেষ করে রাজধানীর নদী,খালবিল,পুকুর ভরাট করে বাড়ীঘর তৈরি করার কারণে রামপুরা,বেগুনবাড়ী খালের আশপাশ, পাগলা খালের দক্ষিণে বুড়িগঙ্গার দক্ষিণ এলাকা,আদাবর,বসুন্ধরা,
বনশ্রী,শ্যামলী ও তুরাগ নদী সংলগ্ন এলাকায় ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ হবে সবচেয়ে বেশি।কারণ এসব এলাকার মাটি তুলনামূলকভাবে নরম। তবে শক্ত মাটিতে ভূমিকম্প কম অনুভূত হয়।এছাড়া অপরিকল্পিত নগরায়ণ, মানসম্মতভাবে মাটির গুণাগুণ যাচাই ও পাইলিংনা করা, বিল্ডিংকোড অনুসরণ ও ভূমিকম্প সহনীয় করে তৈরি না করা এবং নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার করার কারণে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পেও নেমে আসতে পারে বড় ধরনের বিপর্যয়।
দুই হাজার বারো সালের আঠারো সেপ্টেম্বর রবিবার সন্ধ্যায় কেঁপে উঠেছিল পুরো দেশ।প্রায় দুই মিনিট ধরে এই কম্পনে প্রাণহানির ঘটনা না ঘটলেও বিভিন্ন স্থানে কাঁচা ঘর বাড়ি ধসে পড়েছে।অনেক পাকা বহুতল ভবনে ফাটল দেখা দিয়েছে ।মানুষের মন থেকে এসব আতঙ্কের রেশ কাটতে না কাটতেই হয়ে গেল আরও একটি ভূমিকম্প।সত্যি কথা বলতে কি বাংলাদেশের ইতিহাসে এটিই সর্বোচ্চ তীব্রতার ভূমিকম্প।এটিই শেষ কথা নয়।সামনে অপেক্ষা করছে আট বা এর বেশি তীব্রতার ভূমিকম্প।তাও আবার একটি-দুটি নয়, অন্তত সাতটি এ ধরনের ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে বাংলাদেশে।দুই হাজার পাঁচ সালে দেশি বিদেশি বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে এমন বার্তা ওয়াশিংটনে পাঠিয়েছিল ঢাকার মার্কিন দূতাবাস।তাতে বলা হয়েছিল, আগামী দশ বছরের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে এ দুর্যোগ আসতে পারে বাংলাদেশের জন্য।তবে ভূমিকম্প মোকাবিলায় বাংলা দেশের প্রস্তুতি চরম হতাশাজনক বলেও তাঁরা মন্তব্য করেন।বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞের সহায়তায় সরকার এ ব্যাপারে খুবই ধীর গতিতে এগুচ্ছেন বলে তাঁরা উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
সাম্প্রতিক শক্তিশালী ভূমিকম্পটি আবারও প্রমান করেছে, বাংলাদেশ ভূমিকম্প ফল্টের অধীন ঝুঁকিপ্রবণ এলাকার অন্তরভুক্ত।যে কোন সময় এখানে ঘটে যেতে পারে বড় ধরনের বিপর্যয়।যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্তা ইউ এস জি এসের তথ্য অনুযায়ী,রিখটার স্কেলে ছয় দশমিক নয় মাত্রার এ ভূমিকম্পের কেনদ্র ছিল ভারতের সিকিমের গেঙগটকের ছেচল্লিশ কিলোমিটার উওর-পশ্চিমে এবং ঢাকা থেকে প্রায় পাঁচশত কিলোমিটার দূরে।বিশেষজ্ঞের মতে ঢাকা থেকে মাএ একশত কিলোমিটার দূরে মধুপুর ফল্টে এ ধরনের ভূমিকম্প হলে রাজধানীতে নেমে আসবে বড় ধরনের বিপর্যয়।তাই আগাম সতর্কতা গ্রহণ করা প্রয়োজন এখনই বাংলাদেশ ভূমিকম্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক এবং ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা মনে করেন ভূমিকম্প মোকাবিলায় এখনই আগাম প্রস্তুতি গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন।এর পরও আমরা যদি সাবধান না হই,এবং দেখেও না দেখার ভান করে এবং শুনেও না শুনার ভান করে এত বড় একটা দুর্যোগ এড়িয়ে যাই তবে বিরাট ভূল হবে,আর এই ভূলের খেসারত কিছুতেই পূরণ করা যাবে না।
রাজধানীতে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন প্রায় সত্তর হাজার বা তার চেয়েও বেশি হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।তবে দুখ জনক হলেও সত্য, ঢাকার কতটি ভবন ভূমিকম্প ঝুঁকি পূর্ণ তার নির্দিষ্ট কোন তথ্য নেই সরকারের কাছে।এ সংখ্যা অঞ্চল ভিত্তিক সমীক্ষা অনুযায়ী চিহ্নিত করা হয়েছে বলে উললেখ করেছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়।সওর হাজার ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করা প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞ মকসুদ কামাল বলেছেন এটি আসলে বাড়ি বাড়ি গিয়ে কোন পরীক্ষা করা হয়নি।এমন কি ঝোঁকিপূর্ণ কোন তালিকাও তৈরি করা হয়নি।তবে আমার মতে এই উদাসীনতার বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে এসে দেশের জনগণের চিন্তা মাথায় রেখে এখনই এ ব্যাপারে সচেষ্ট হওয়ার সময়।তানাহলে এমন ভয়াবহ দুর্ঘটনা থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারব কি না সন্দেহ আছে।
সরকারি তথ্যসূত্রমতে ঢাকায় রাতের বেলায় সাত থেকে সাত দশমিক মাত্রার ভূমিকম্প হলে নব্বই হাজার মানুষ হতাহত হবে।আর দিনের বেলায় হলে হতাহতের সংখ্যা হবে সওর হাজারের মত।ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকার তিন লাখ ছাব্বিশ হাজার ভবনের উপর পরিচালিত সমীক্ষা অনুযায়ী দেখা গেছে, এমন তীব্রতার ভূমিকম্পে প্রায় বাহাওর হাজার ভবন সম্পূর্ণ মাটিতে মিশে যাবে।এবংপচাশি হাজার ভবন মাঝারি ধরনের ক্ষতিগ্রস্ত হবে।শুধু দালান ভাঙার কারণে ক্ষয়ক্ষতি হবে ছয় বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমতুল্য সম্পদ।এমন কি জাতিসংঘ পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে ভূতাত্ত্বিক ঝুঁকিপূর্ণ বিশ্বের বিশটি শহরের মধ্যে ঢাকাও অন্যতম।তাই ভূমিকম্পের এই মারাত্মক আঘাত হতে দেশ ও জাতির স্বার্থে সকলকে সচেতন করতে এখনই জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া একান্ত প্রয়োজন বলে সাধারণ মানুষ মনে করেন।পরিশেষে মাননীয় সরকার ও এতদ সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি বিনীত অনুরোধ থাকবে এ ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে আরো সচেষ্ট ভূমিকা রাখবেন।দোয়া করি মহান আল্লাহ্র আমাদের সবাই কে হেফাজতে রাখুন।