কারিগরি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা
প্রকাশিত হয়েছে : ১:২৮:১৪,অপরাহ্ন ১০ জুন ২০২০ | সংবাদটি ৩৪২৩ বার পঠিত
মসরুফ আহমদ চৌধুরী
এস.এস.সি ও সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ সকল ছাত্র-ছাত্রীদের অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা।
হয়তো করোনা পরিস্থিতির মধ্যেই খুব শ্রীঘই অনলাইনে উচ্চ মাধ্যমিক ভর্তি কার্যক্রম শুরু হবে।সফল ক্যারিয়ার গঠনে এখনই ভেবে-চিন্তে পরবর্তী একাডেমিক শিক্ষার জন্য ভর্তি হতে হবে। তাই আমার এই লেখা হয়তো তোমাদের উপকারে আসবে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে।
জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন ছিল সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ার। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বুলেটের আঘাতে সে স্বপ্ন স্তিমিত হয়ে যায়। ১৯৭৫-পরবর্তী সময়ে জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে কেউ ভাবেননি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৮ সালে জাতির জন্য লক্ষ্য নির্ধারণ করেন অর্থাৎ ভিশন-২০২১ ঘোষণা করেন। যার মূল দর্শন হচ্ছে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উদ্ভাবনী শক্তির বিকাশ ঘটিয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের মানবসম্পদ, প্রাকৃতিক সম্পদ ও অন্যান্য সম্পদের দক্ষতা বাড়িয়ে দারিদ্র্যবিমোচন, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তর করা এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বিশ্বের কাতারে স্থান করে নেওয়া।
বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হল “কারিগরি শিক্ষা নিলে বিশ্ব জুড়ে কর্ম মিলে”। বর্তমানে সব জায়গায় অভিজ্ঞ ও দক্ষ জনশক্তির ব্যাপক চাহিদা। কারিগরি শিক্ষা নিলে কখনই বেকার থাকতে হয় না। এই বিষয়ে পড়লে চাকরি খুঁজতে হবে না। নিজে স্বাবলম্বী হতে চাইলে, ল্যাব অথবা ওয়ার্কশপ দেয়া যায়। তৈরি করা যায়, নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ।কারিগরি শিক্ষায় তত্ত্বীয় পড়াশুনার চেয়ে বাস্তব প্রয়োগে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়, যাতে করে একজন কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তি নিজের যোগ্যতাকে কাজে লাগিয়ে সবচেয়ে ভালো কাজের সুযোগ খুঁজে নিতে পারে ।বাস্তব কাজের অভিজ্ঞতা থাকায় কারিগরি শিক্ষাকে চাকুরির ক্ষেত্রেও খুব গুরুত্বের সাথে দেখা হয়। একজন চাইলে খুব সহজেই কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করে নিজের পূর্বের কাজ থেকে বেরিয়ে নতুন কাজ করতে পারে এবং নিজের ক্যারিয়ার কে সমৃদ্ধ করতে পারে।শিক্ষায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কারিগরি শিক্ষা কার্যক্রমের প্রসারিত চিত্র হতে দেখতে পাই জার্মানিতে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিতের হার শতকরা ৭৩ ভাগ, সিংগাপুরে ৬৫, জাপানে ৬৬, দক্ষিণ কোরিয়াতে ৫০ এবং মালয়েশিয়াতে ৪৬ ভাগ। উন্নত দেশ যেমন- জার্মানি, জাপান, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়ার উন্নতির পেছনে রয়েছে এই কারিগরি শিক্ষা। আমাদের দেশের কারিগরি শিক্ষার হার অনেক কম উন্নত দেশের তুলনায়। তাই এই শিক্ষা শুধু ব্যক্তি কিংবা পরিবারকে নয়, দেশেরও উন্নতি করবে।
পড়াশুনা:
কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ক্যারিয়ার গড়তে চাইলে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে ৪ বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা-ইন-ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে পড়াশোনার সুযোগ রয়েছে। বর্তমানে ৪৯টি সরকারী পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট,৬৪টি সরকারী টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজ এবং বেসরকারি ৩৮৭ টি রয়েছে। বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড-এর অধীনে চার(৪) বছর মেয়াদী শিক্ষাক্রম পরিচালিত হয়। চার বছর মেয়াদী শিক্ষাক্রম আটটি(৮) পর্বে বিভক্ত যাদের সেমিষ্টার বলা হয়। এক একটি সেমিষ্টারের কার্য দিবস ১৬-১৮ সপ্তাহ। সে হিসেবে প্রতি বর্ষের কার্য দিবস ৩২-৩৬ সপ্তাহ। নির্ধারিত কার্য দিবস শেষ হওয়ার পর পর্ব সমাপণি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।
অন্তর্ভুক্ত কোর্সগুলো :
বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে পরিচালিত চার(৪) বছর মেয়াদী ৫৯টি টেকনোলজি আছে। উল্লেখযোগ্য টেকনোলজি হল- ডিপ্লোমা-ইন-সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং, ডিপ্লোমা-ইন-ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ডিপ্লোমা-ইন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ডিপ্লোমা-ইন-ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং, ডিপ্লোমা-ইন-কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং, ডিপ্লোমা-ইন-পাওয়ার, ডিপ্লোমা-ইন-আর্কিক্টেচার, ডিপ্লোমা-ইন-অটোমোবাইলস, ডিপ্লোমা-ইন কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ডিপ্লোমা ইন এগ্রিকালচার, ডিপ্লোমা ইন ফরেস্ট্রি, ডিপ্লোমা ইন মেরিন টেকনোলজি, ডিপ্লোমা ইন হেল্থ টেকনোলজি।
ভর্তির শিক্ষাগত যোগ্যতা :ভর্তির জন্য ২০১৮,২০১৯,২০২০ সালে পাসকৃত এস.এস.সি/সমমান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এবং ছেলেদের ক্ষেত্রে সাধারণ গণিত বা উচ্চতর গণিতে কমপক্ষে জি.পি.এ ৩.০০ সহ ন্যূনতম ৩.৫০ জি.পি.এ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা এবং মেয়েদের ভর্তির ক্ষেত্রে সাধারণ গণিত বা উচ্চতর গণিতে কমপক্ষে জি.পি.এ ৩.০০ সহ ন্যূনতম ৩.০০ জি.পি.এ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা আবেদন করতে পারবে।
উচ্চশিক্ষা :ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা শেষে মানোন্নয়ন ও গবেষণার সুযোগ লাভের জন্য দেশে-বিদেশে উচ্চশিক্ষা নেয়ার ব্যবস্থা আছে। আগ্রহ থাকলে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং, এমএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং ও পিএইচডি করা যায়।
রোজগার :সাধারণত, পেশাগত জীবনে এ ক্যারিয়ারে আয় ও রোজগারের বিষয়টি নির্ভর করে কর্মদক্ষতা, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং কাজের মনোযোগের ওপর। যেমন এখানে লেখাপড়া করে যে কেউ শুরুতেই মাসে ২০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা আয় করতে পারেন। এছাড়া সরকারি জব করতে চাইলে সরকারি বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা যেমন-চিকিৎসক ভাতা, বাড়িভাড়া ইত্যাদি বাদে সরকারি স্কেল অনুযায়ী আপনার বেতন ধরা হবে ১৬০০০ হাজার টাকা। বিশেষজ্ঞদের মতে একজন লোক তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে মাসে ৮০ থেকে ১ লাখ টাকা আয় করতে পারেন। এমনকি মাসে দেড় লাখ পর্যন্ত আয় করা সম্ভব। উল্লেখ্য, সরকারি ফার্মের চেয়ে বেসরকারি ফার্মে আয়ের পরিমাণ অনেক বেশি।
ক্যারিয়ার সম্ভাবনা :কারিগরি শিক্ষায় রয়েছে বহুমুখী স্বপ্নের উজ্জ্বল ক্যারিয়ার। চাকরির জন্য রয়েছে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অনেক ক্ষেত্র। যেমন- ডিপ্লোমা-ইঞ্জিনিয়ারদের চাকরির সবচেয়ে বড় বাজার হল সরকারি ইপিজেডগুলো, গাজীপুর মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি, পাওয়ার জেনারেটর প্লান্ট, ডেসকো, বিটিসিএল,ওয়াসা,পানি উন্নয়ন বোর্ড, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড । এছাড়া রিয়েল এস্টেট কোম্পানি, সয়েল টেস্ট ফার্ম, কনস্ট্রাকশন, হাইভোল্টেজ ক্যাবল লাইন, , হাউস ওয়ারিং, শিল্প-কলকারখানা, বিভিন্ন স্ট্রাকচার ডিজাইন ফার্ম, ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন অ্যান্ড ডিজাইন ফার্ম, ই-কম্পিউটার ডিজাইনার ডাটা, অ্যান্ট্রি, মেডিকেল ট্রান্সক্রিপশন, সফটওয়ার ফার্ম, হার্ডওয়ার ফার্ম, গ্রাফিকস ডিজাইন, বিভিন্ন ট্রেনিং প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন টেক্সটাইল মিল, গার্মেন্ট অ্যান্ড ফ্যাশন হাউস, গ্লাস অ্যান্ড সিরামিক ডিজাইন সরবরাহ ও প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো, পল্লীবিদ্যুৎ, মেডিকেল ল্যাব, একাধিক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি ও ওষুধ কোম্পানিসহ দেশে-বিদেশে শত শত প্রতিষ্ঠানে রয়েছে বহুমাত্রিক ক্যারিয়ারের সুবর্ণ সুযোগ। কারণ এসব প্রতিষ্ঠানে রয়েছে ডিপ্লোমা ইজ্ঞিনিয়ারদের ব্যাপক চাহিদা। মোটকথা ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের বেকার থাকা বা কাজ না পাওয়ার আশংকা খুব কম। এখানে পড়াশোনা শেষ করেই রয়েছে চাকরির নিশ্চয়তা। রয়েছে সফল ক্যারিয়ারের হাতছানি। আর দেরি না করে এ পেশায় গড়তে পারেন আপনার স্বপ্নের রঙিন ক্যারিয়ার। বিস্তারিত জানতে লেখক ০১৭১৭৫৩৪১৫২, www.techedu.gov.bd, www.bteb.gov.bd.
লেখক. মসরুফ আহমদ চৌধুরী, (বি.এস.সি ইঞ্জিনিয়ার), ইন্সট্রাক্টর, মৌলভীবাজার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট।