বিলুপ্তির পথে বসেছে যে পাখি
প্রকাশিত হয়েছে : ৯:০২:৪৯,অপরাহ্ন ২৬ আগস্ট ২০১৯ | সংবাদটি ৩৮৯ বার পঠিত
ই না ম আ ল হ ক
‘বার্ডলাইফ ইন্টারন্যাশনাল’-এর পরিসংখ্যান বলে যে, আজকের দিনে পাখির সবচেয়ে বেশি বিলুপ্তি ঘটছে এশিয়া মহাদেশে। ৫০ বছর ধরে এ মহাদেশটিতে সবচেয়ে দ্রুতগতিতে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে। জাপান, কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের মতো বেশ কয়েকটি দেশে দ্রুত উন্নয়ন হয়েছে; এখন চীন ও ইন্ডিয়ায় হচ্ছে। উন্নয়নের চাকার নিচে পাখির আলয় ধূলিসাৎ হচ্ছে। প্রকৃতি সংরক্ষণে সুশীল সমাজের কণ্ঠ জোরদার হয়ে ওঠার আগেই ওসব দেশে পাখির প্রভূত ক্ষতি হয়ে গেছে।
‘বার্ডলাইফ ইন্টারন্যাশনাল’-এর মতে, বর্তমান বিশ্বে বিপদের মুখে রয়েছে যেসব পাখি তার ৩৫টি প্রজাতি বাংলাদেশে আছে। এ পাখিগুলোর মধ্যে যে সাত প্রজাতির পাখি টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মানুষ খুব বড় অবদান রাখতে পারে, এখানে সে আলোচনা করব। বাংলাদেশের আইনে এসব পাখি ধরা, মারা, খাওয়া, সবই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তাই বলে আমরা যারা কখনও পাখি মারি না এবং বুনোপাখির মাংস খাই না তাদের এ কথা মনে করার অবকাশ নেই যে, এটুকু করেই পাখি সংরক্ষণে আমরা যথেষ্ট অবদান রাখছি। এদের ব্যাপারে আমাদের যে আরও অনেক কিছু করার আছে, সে কথাটাও এখানে একটু বলতে চাই।
ধরে রাখার জন্য বিশ্বের মানুষ উঠেপড়ে না লাগলে যে পাখির টিকে থাকার কোনো আশা নেই তাকে বলা হয় ‘মহাবিপন্ন’। বিশ্বের পাঁচটি মহাবিপন্ন পাখি আমাদের পিতা-পিতামহের আমলে বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এদের নাম গোলাপি-হাঁস, বাংলা-ডাহর, ধলাপেট-বক, সরুঠুঁটি-শকুন ও রাজ-শকুন। গোলাপি-হাঁস ছাড়া বাকি চার জাতের পাখি পৃথিবীর কোথাও না কোথাও আজও টিকে আছে; তবে বাংলাদেশে কোনোদিন এদের দেখা পাওয়ার আশা আর আমরা করি না। বিশ্বের যে দুটি মহাবিপন্ন পাখি আজও এদেশে টিকে আছে তাদের ধরে রাখার জন্যই আমাদের সর্বশক্তি ব্যয় করতে হবে। এদের নাম বাংলা-শকুন এবং চামচঠুঁটো-বাটান। এ দুটি পাখির অবস্থা এতই সঙ্গিন যে, এদেশের সচেতন মানুষের সব শক্তি দিয়েও এদের রক্ষা করা সম্ভব হবে, এমন নিশ্চয়তা নেই। তবে যত দূর সম্ভব আমরা চেষ্টা করতে চাই।
জেনে অনেকেই হয়তো অবাক হবেন, শকুন নামে অতিকায় যে পাখিকে আমরা সবাই চিনি, সে পাখিটিই এখন বিশ্বে মহাবিপন্ন। এর পোশাকি নাম বাংলা-শকুন এবং আন্তর্জাতিক নাম ‘জিপস বেঙ্গালেনসিস’ যার অর্থ বাংলার শকুন। তিন দশক আগেও এদেশে হাজার হাজার শকুন ছিল; এখন সবই প্রায় শেষ। আমাদের অনুমান, বাংলাদেশে এখন মাত্র চারশ শকুন বেঁচে আছে। গরু-ছাগলের চিকিৎসায় ‘ডাইক্লোফেনাক’ নামের যে ওষুধ দেওয়া হয় তার বিষক্রিয়ায় শকুন মারা যায়। এ ওষুধ ব্যবহারের ফলে ৩০ বছরে উপমহাদেশের ৯৯ শতাংশ শকুন মারা গেছে। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ওষুধটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে; কিন্তু এর ব্যবহার বন্ধ হয়নি। শকুন বাঁচিয়ে রাখতে হলে পশু-চিকিৎসায় ‘ডাইক্লোফেনাক’ বর্জন করে এর বিকল্প ওষুধ ‘মেলোক্সিক্যাম’ ব্যবহারে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে আমাদের। দেশের ওষুধ প্রস্তুতকারক, ড্রাগস্টোর, ড্রাগ-কন্ট্রোলার, পশু-চিকিৎসকরা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন।
আকারের বিশালতা ও পরিচিতির পরিমাপে শকুনের সঙ্গে কোনো তুলনাই চলে না এদেশের দ্বিতীয় মহাবিপন্ন পাখিটির। এর নাম চামচঠুঁটো-বাটান; বাংলাদেশের ক্ষুদ্রতম সৈকতপাখি। আকারে চড়–ইয়ের সমান এ পাখিটি এদেশের কম মানুষেরই চেনা প্রাণীর তালিকায় পড়ে। পৃথিবীতে এর সংখ্যা বড়জোর ৫০০। কাদাপানি থেকে খাবার সংগ্রহ করার জন্য এর চঞ্চুর প্রান্ত চামচের মতো গোল। গ্রীষ্মে সাইবেরিয়ায় এরা বাসা বাঁধে এবং শীতে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের উপকূলে বাস করে। সোনাদিয়া দ্বীপেই পৃথিবীর ১০ শতাংশ চামচঠুঁটো-বাটান বেঁচে থাকে। এ মহাবিপন্ন পাখিটিকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে সোনাদিয়ার কাদাচরে লবণ-চাষ ও চিংড়ি-ঘের করা, পাকা বাঁধ দেওয়া এবং পোর্ট বানানো নিরুৎসাহিত করতে হবে আমাদের।
মহাবিপন্ন পাখির চেয়ে একটুখানি কম বিপদে রয়েছে যেসব পাখি তাকে বলা হয় ‘বিপন্ন’ পাখি। এদের সংরক্ষণের জন্য মানুষের হাতে আরেকটু বেশি সময় আছে। আমরা জানি বিশ্বের চার প্রজাতির বিপন্ন পাখি এদেশ থেকে সম্প্রতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে; এদের নাম সবুজ-ময়ূর, বাদি-হাঁস, ধলা-শকুন ও বড়-মদনটাক। এ পাখিগুলো বাংলাদেশে আর কোনােদিন দেখার সম্ভাবনা নেই; যদিও অন্য দেশে এদের আজও পাওয়া যায়। আমাদের দেশে বিশ্বের যে তিনটি বিপন্ন পাখি আজও টিকে আছে তার নাম বেয়ারের-ভুতিহাঁস, নর্ডম্যান-সবুজপা ও কালামুখ-প্যারাপাখি। এর মধ্যে কালামুখ-প্যারাপাখি সংরক্ষণের দায়ভারটা আমাদের ওপরই বেশি বর্তায়, কারণ এর টিকে থাকার জন্য সুন্দরবনের চেয়ে ভালো আবাস বিশ্বে আর নেই।
অনেকটা পাতি-হাঁসের মতো দেখতে কালামুখ-প্যারাপাখি সুন্দরবনের গহিনে জোড়া বেঁধে বাস করে। সুন্দরবন ছাড়া বাংলাদেশের আর কোথাও পাখিটির অস্তিত্ব নেই। বাঘের মতোই নিভৃতচারী এ পাখির সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাচ্ছে। সম্ভাব্য বিলুপ্তি রোধের জন্য সুন্দরবনে এর আবাস কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত যেন না হয়, তা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু সুন্দরবনের পানিতে তেল ও অন্যান্য বর্জ্য ফেলার প্রভাব পাখিটির জন্য কতটা ক্ষতিকর হতে পারে, তা এখনও আমাদের অজানা। বনের উত্তরে লোকালয়-সংলগ্ন খালে আজকাল বিষ দিয়ে মাছ মারা হয়। কালামুখ-প্যারাপাখির জন্য এটা কত ভয়াবহ হতে পারে, তা-ও অজানা। তবে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এসব কাজ সুন্দরবন ও বনের কোনো প্রাণীর জন্য যে ভালো হতে পারে না, তা বলাই বাহুল্য।
বিপদের ভয়াবহতার দিক থেকে আরেক ধাপ নিচে রয়েছে যেসব পাখি তারা পড়ে ‘সংকটাপন্ন’ দলে। বিশ্বের যে চার প্রজাতির সংকটাপন্ন পাখি আমাদের দেশ থেকে অতি-সম্প্রতি হারিয়ে গেছে তার নাম বাদা-তিতির, দেশি-সারস, শতদাগি-ঘাসপাখি ও কালাবুক-টিয়াঠুঁটি। তবে যা হারিয়েছে তার চেয়ে বেশি এখনও আছে; বৈশিক সংকটাপন্ন ১২ প্রজাতির পাখি বাংলাদেশে আছে বলে আমরা নিশ্চিতভাবে জানি। এর মধ্যে যে চার জাতের পাখির কথা না বললেই নয়, তা হলোÑ দেশি-গাংচষা, ছোট-মদনটাক, পালাসি-কুরাঈগল ও বড়-গুটিঈগল। এ চার প্রজাতির পাখি সংরক্ষণের বিশেষ তাগিদ রয়েছে আমাদের মধ্যে।
দেশি-গাংচষা ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে পৃথিবী থেকে এবং এর বিলুপ্তি রোধ করার ক্ষমতা আছে শুধু ভারত ও বাংলাদেশের মানুষের। বিশ্বে এ পাখির সংখ্যা পাঁচ হাজারেরও কম এবং ক্রমেই তা আরও কমছে। হাতিয়া ও নিঝুম-দ্বীপের মাঝে বয়ে যাওয়া মুক্তারিয়া-খাল আর তার পুবে সদ্য জেগে-ওঠা দমার-চর পৃথিবীর অধিকাংশ দেশি-গাংচষার শীতের আবাস। এখানে টিকে না থাকলে পাখিটি পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হতে বাধ্য। নিঝুম-দ্বীপকে ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ ঘোষণা করে সরকার এসব অঞ্চল সংরক্ষণের কাজে হাত দিয়েছে। এ কাজে সমর্থন ও সহায়তা দেওয়ার একটা দায়িত্ব আছে আমাদের।
বড়-মদনটাক চিরবিদায় নিলেও ছোট-মদনটাক কিন্তু বাংলাদেশে আজও টিকে আছে। সুন্দরবনেই এদেশের অধিকাংশ মদনটাকের বাস। মদনটাকই বাংলাদেশের বৃহত্তম পাখি এবং সুন্দরবনের মতো বিশাল বাদাভূমি ছাড়া এর টিকে থাকার কোনো উপায় নেই। এ পাখি দক্ষ শিকারি নয়, কুড়িয়ে খায়; মৃত মাছ, সরীসৃপ ইত্যাদি খেয়ে এরা বাদাবন পরিচ্ছন্ন রাখে। বিষটোপ দিয়ে মাছ মারার ফলে বর্জ্যভুক এই পাখিটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। সুন্দরবনের পানিতে বিষ দেওয়া এবং বর্জ্য ফেলার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার মূল দায়িত্ব আমাদের বন বিভাগের। এ কাজে জনসমর্থন জোগানোর কাজটি কিন্তু আমাদের সবার।
বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় পাওয়া যায় সংকটাপন্ন দুটি ঈগল; পালাসি-কুরাঈগল ও বড়-গুটিঈগল। সিলেট বিভাগের হাওর অঞ্চলেই এদের বেশি দেখা যায়। হাওর এলাকাতেই পালাসি-কুরাঈগল বাসা বাঁধে। পাখিটির প্রজননের জন্য এর চেয়ে ভালো জলাভূমি বিশ্বে সম্ভবত আর নেই। বর্ষায় এরা কিন্তু হাওরে থাকে না; হিমালয় পেরিয়ে তিব্বতের হ্রদে মাছ শিকার করতে যায়। বড়-গুটিঈগলও গ্রীষ্মে এদেশ ছেড়ে যায়। দুটি ঈগলই দূরপাল্লার পরিব্রাজক পাখি। বাংলাদেশ একটির জন্মস্থান এবং অন্যটির শীতের আবাস। আমাদের হাওরের পরিবেশ কতটা কলুষিত হচ্ছে তার ওপরই অনেকটা নির্ভর করে এ বৈশিক সংকটাপন্ন দুটি ঈগলের টিকে থাকা না থাকা।
ইজারাদারের হাতে বিল ছেড়ে দেওয়ার ফলে বিগত কয়েক দশকে হাওর-বেসিনে পরিবেশের যে অপরিসীম ক্ষতি হয়েছে, তা অনেকেই স্বীকার করেন। হাওরের পানি-সহিষ্ণু হিজল-করচ-বরুণের বন উজাড় হয়েছে, পাখি ও স্তন্যপায়ী প্রাণী প্রায় সবই বিদায় নিয়েছে, এখন মাছের আকাল চরমে উঠেছে। ভাগ্যক্রমে এ ইজারা-ব্যবস্থা উঠিয়ে দিয়ে হাওরে টেকসই ব্যবস্থাপনার কথা সম্প্রতি আলোচনার টেবিলে এসেছে। মাছসহ হাওরের অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণের জন্য আমাদের দাবি জানানোর এটাই সময়।
বিশ্বের বিপন্ন সাতটি প্রজাতির পাখি সংরক্ষণে বাংলাদেশের মানুষ যে কত বড় ভূমিকা রাখতে পারে তার একটা আভাস আশা করি পেলেন। পাখি ধরা-মারা-খাওয়া বন্ধ করলেই সংরক্ষণের কাজ সমাপ্ত হয় না; পাখির বিচরণের আর প্রজননের জায়গাগুলোও টিকিয়ে রাখতে হয়। সেজন্যই হাওরের বিলগুলো কার হাতে পড়ল, সুন্দরবনের সন্নিকটে পানি দূষণের কতগুলো কারখানা গজাল, সোনাদিয়ায় লবণ-চাষ কতটা সম্প্রসারিত হলোÑ এসবই আমাদের হিসাব রাখতে হবে। সরকারসহ সমাজের প্রধান বলকেন্দ্রগুলো স্বল্পমেয়াদি সুবিধার লোভে তাড়িত না হয়ে যেন টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে পরিকল্পিত পরিবেশবান্ধব কর্মকা-ে নিয়োজিত হতে পারে, সেজন্য আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে।