বিপদে পাশে থাকুন…..
প্রকাশিত হয়েছে : ৯:০৯:২২,অপরাহ্ন ২৬ আগস্ট ২০১৯ | সংবাদটি ৪০৩ বার পঠিত
ইউসুফ জামিল নূর
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেনÑ ‘মুসলমান মুসলমানের ভাই, সে তার ওপর জুলুম করবে না এবং তাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেবে না। যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের অভাবে সাহায্য করবে, আল্লাহ তায়ালা তার অভাবে সাহায্য করবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানের দুঃখ-কষ্ট দূর করবে, আল্লাহ তায়ালা কেয়ামতের দিন তার বিপদগুলোর কোনো একটি বিপদ দূর করে দেবেন। আর যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানের দোষত্রুটি ঢেকে রাখবে, আল্লাহ তায়ালা কেয়ামতের দিন তার দোষত্রুটি ঢেকে রাখবেন।’ (বোখারি : ২৩১০; মুসলিম : ২৫৮০)।
ইমাম নববি বলেছেন, ‘উপর্যুক্ত হাদিসে মুসলমানকে সাহায্য করা, তার সংকট দূর করা ও তার দোষত্রুটি গোপন রাখার মাহাত্ম্য এবং ফজিলত প্রকাশ পেয়েছে। কেউ সম্পদ দিয়ে বা সামর্থ্য দিয়ে বা সহযোগিতা দিয়ে সংকট দূর করলে সে সংকট থেকে উদ্ধারকারী ও আপদে সাহায্যকারী বিবেচিত হবে। অনুরূপ কেউ বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে, মতামত জানিয়ে সংকটে ও আপদে সাহায্য করলেও অনুরূপ সাহায্যকারী গণ্য হবে।’ (আল-মিনহাজ, শারহু সহিহ মুসলিম, খ. ১৬, পৃ. ১৩৫)। মূলত এটাই মুসলিম সমাজে পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতার মর্মার্থ। অর্থাৎ জাতির ব্যক্তিম-লী তাদের গোষ্ঠীর ও সমষ্টির সহযোগিতায় থাকবে; প্রত্যেক সামর্থ্যবান ও ক্ষমতাবান ব্যক্তি সমাজে কল্যাণকর কাজের জিম্মাদার হবে; সমাজের মানবিক শক্তিগুলো ব্যক্তির কল্যাণ সংরক্ষণে ও ক্ষতি প্রতিহতকরণে সক্রিয় থাকবে এবং সমাজ-গঠন ও একে নিরাপদ ভিত্তিগুলোর ওপর প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সমস্যা ও জটিলতা প্রতিহত করবে। জনম-লী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর মধ্যে এবং প্রত্যেক মানুষের সঙ্গে প্রত্যেক মানুষের দৃঢ় বন্ধনে একে অপরের সঙ্গে থাকবে।
তা ছাড়া নবী করিম (সা.) মুখাপেক্ষীদের সাহায্য করা এবং আমরা যে সমাজে বাস করি তার সদস্যদের প্রতি দায়িত্বশীলতার অনুভূতিকে নিজের ওপর সদকা বলে গণ্য করেছেন। আবু জর (রা.) থেকে বর্ণিতÑ ‘সূর্য উদিত হয় এমন প্রত্যেক দিবসে প্রত্যেক ব্যক্তির ওপর তার নিজের জানের সদকা রয়েছে।’ আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল, আমি কোথা থেকে সদকা করব, আমাদের তো সম্পদ নেই? তিনি বললেন, ‘কারণ সদকার প্রকারগুলোর মধ্যে এগুলোও রয়েছেÑ তুমি অন্ধকে পথ দেখিয়ে দেবে; বধির ও বোবাকে শুনিয়ে দেবে (কথাবার্তা বুঝিয়ে দেবে), যাতে সে বুঝতে পারে; কেউ তার প্রয়োজনে নির্দেশনা চাইলে তুমি তাকে পথ দেখিয়ে দেবে, যা তোমার জানা আছে; সাহায্যপ্রার্থী আর্তমানবের সাহায্যে দৌড়ে যাবে; তোমার দুই হাত লাগিয়ে দুর্বলকে সাহায্য করবেÑ এগুলোর প্রত্যেকটি তোমার পক্ষ থেকে তোমার জানের ওপর সদকা।’ (আহমদ : ২১৫২)।
এসব মূল্যবোধ শ্রেষ্ঠ সভ্যতার আলামত বলে বিবেচিত। ইসলাম এক্ষেত্রে যাবতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা ও মতাদর্শ থেকে অগ্রগামী; কারণ অন্যরা এসব কাজের প্রতি অনেক পরে গুরুত্ব দিয়েছে। তা না হলে কে কবে অন্ধকে পথ দেখিয়ে দেওয়া এবং বধির ও বোবাকে কথা শোনানোর কথা শুনেছে?!
রাসুলুল্লাহ (সা.) মানুষের প্রয়োজন পূরণে সামর্থ্যবানদের শৈথিল্য প্রদর্শনের ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। আমর ইবনে মুররা (রা.) মুআবিয়া (রা.) কে বলেছেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.) কে বলতে শুনেছিÑ ‘যে কোনো নেতা (রাষ্ট্রীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত) মুখাপেক্ষী ও অভাব-অনটনগ্রস্ত লোকদের মুখের ওপর তার দরজা বন্ধ করে রাখে (তার কাছে আসতে বাধা প্রধান করে), আল্লাহ তায়ালা তার প্রয়োজন ও অভাব-অনটনের সময় আসমানের দরজাগুলো বন্ধ করে রাখবেন।’ (তিরমিজি : ১৩৩২; আহমদ : ১৮০৬২)। বর্ণনাকারী বলেন, এ হাদিস শুনে মুআবিয়া (রা.) মানুষের প্রয়োজন পূরণে একজন লোক নিযুক্ত করলেন।
জাবির ইবনে আবদুল্লাহ ও আবু তালহা আল-আনসারি (রাদিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণিত, তারা বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেনÑ ‘যে কোনো মুসলমান তার কোনো মুসলমান ভাইয়ের এমন জায়গায় সাহায্য পরিত্যাগ করবে, যেখানে তার সম্মানের লাঘব হচ্ছে বা ইজ্জতহানি হচ্ছে, আল্লাহ তায়ালা এমন জায়গায় তার সাহায্য পরিত্যাগ করবেন, যেখানে সে সাহায্য পাওয়ার আকাক্সক্ষা করবে। আর যে কোনো মুসলমান তার কোনো মুসলমান ভাইকে এমন জায়গায় সাহায্য করবে, যেখানে সে অসম্মানিত হচ্ছে বা অপদস্থ হচ্ছে, আল্লাহ তায়ালা তাকে এমন স্থানে সাহায্য করবেন, যেখানে সাহায্যপ্রাপ্তির আকাক্সক্ষা করে।’ (আবু দাউদ : ৪৮৮৪; আহমদ : ১৬৪১৫)।
পারস্পরিক সহযোগিতার বিষয়টিকে দৃঢ়ীকরণে মুসলিম ফকিহদের আশ্চর্যজনক বক্তব্য রয়েছে। তারা বিধিবদ্ধ করে দিয়েছেন যে, প্রত্যেক মুসলমানের ওপর অপর মুসলমানকে ক্ষতি থেকে বাঁচানো ওয়াজিব। বিপদগ্রস্ত, জলে নিমজ্জিত, অগ্নিদগ্ধ মানুষকে তাৎক্ষণিক উদ্ধারের জন্য নামাজ ভেঙে দেওয়া ওয়াজিব। অর্থাৎ ধ্বংসাত্মক যে কোনো আপদ থেকে উদ্ধার করতে হবে। কোনো ব্যক্তি যদি অপরের সাহায্য ছাড়াই বিপদগ্রস্তকে বিপদ থেকে উদ্ধারের সক্ষমতা রাখে, তাহলে তার জন্য বিপদগ্রস্তকে উদ্ধার করা ফরজে আইন। যদি ঘটনাস্থলে অন্য সক্ষম ব্যক্তি থাকে তাহলে তা ফরজে কেফায়া। এ ব্যাপারে ফকিহদের মধ্যে কোনো মতবিরোধ নেই। (মুগনি আল-মুহতাজ, খ. ৪, পৃ. ৫)।
এসব কারণেই পরাস্পরিক সহযোগিতা ইসলামি সমাজের একটি মৌলিক ভিত্তি। বিপদ ও সংকট দূরীকরণে সাহায্য-সহযোগিতার অনেক পথ ও পদ্ধতি রয়েছে। সাহায্য এগিয়ে দেওয়া, সুরক্ষা প্রদান করা, সমবেদনা জানানো, পাশে দাঁড়ানোর ইত্যাদির মধ্য দিয়ে এগুলো করা যায়। যাতে নিরুপায় ব্যক্তির প্রয়োজন পূরণ হয়, দুশ্চিন্তাগ্রস্তের দুশ্চিন্তা দূর হয়, আক্রান্তের ক্ষত নিরাময় হয় এবং দেহ সবধরনের ব্যাধি ও অসুস্থতা থেকে আরোগ্য লাভ করে।