চারদিকে মুক্তির নিঃশব্দ মিছিল
প্রকাশিত হয়েছে : ১১:৩৮:১০,অপরাহ্ন ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ | সংবাদটি ১১৬০ বার পঠিত
মো. মাহমুদুর রহমান : বাঙ্গালীর মুক্তির মিছিলের পথ যেন অন্তহীন। অতীতের অনেক গলিপথ পেরিয়ে বায়ান্নতেই প্রথম মিছিল আঁচড়ে পড়ে রাজপথে। রক্তস্নাত এ পথ ধরেই ভাষার মুক্তি। তারপর একাত্তরে ভৌগোলিক মুক্তি। এ দেশের মানুষের গৌরবের অমলিন স্তম্ভ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্ত মানুষের স্বপ্ন আকাশ ছোঁয়ে যায়। মনের মুক্ত পাখি আকাশে উড়তে চায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, এ পাখি ওড়ার মতো মুক্ত আকাশ পায়নি কখনও। বারবার ওড়ার চেষ্টা। বারবার ডানা ঝাপটিয়ে মাটিতে পড়ে যাওয়া। স্বপ্ন আর বাস্তবতার বিশাল ব্যবধান মুক্তিকামী মানুষের আশা ভঙ্গের কারন হলেও অদম্য এ ভূখন্ডের মানুষকে মুক্তির স্বপ্ন ত্যাগে বাধ্য করতে পারেনি।
বিষয়টি ভারতীয় সাংবাদিক, কলামিস্ট কুলদীপ নায়ারের ভাষ্যে খুব সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। দি স্টেটসম্যান পত্রিকায় প্রকাশিত লেখার বাংলা অনুবাদ যা মানবজমিনের অনলাইনে ১১ ফেব্রুয়ারিতে এসেছে তাতে শিরোনাম ছিল, ‘বাংলাদেশ তার পথ হারিয়েছে‘। ‘ঢাকায় পৌঁছার পর আপনার বুঝতে খুব বেশি সময় লাগবে না যে, এটাই সেই দেশ, যা তার বৈশিষ্ট্য হারিয়েছে। দূরবর্তী ও শোষণকারী পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামে পূর্ব পাকিস্তানিদের যে বৈপ্লবিক চেতনা উদ্দীপ্ত করেছিল তার বিন্দু মাত্রও এখন নেই।‘ মুক্তিপাগল মানুষের পথ হারানোর বর্ণনা দিয়ে এভাবেই লেখা শুরু করেছেন তিনি। মধ্যখানে এক জায়গায় লিখেছেন- ‘তবু মন্দের ভালো যে, জনগন গনতান্ত্রিক ব্যবস্থা পছন্দ করে।‘ মুক্তিকামী মানুষেরও ভরসার জায়গা এখানেই। মানুষ এখনও একনায়কতন্ত্র বা রাজতন্ত্র পছন্দ করে না। নিজের ভাগ্য নিজেই গড়তে চায়। নিজের সরকার নিজেই নির্বাচন করতে চায়। সেই সুযোগ তারা পাবে কি-না সেটা ভিন্ন প্রশ্ন। এই প্রশ্নে ভারতীয় বর্ষীয়ান সাংবাদিক কুলদীপ নায়ারও আশাবাদী নন। একই নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশে কখনো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে বলে মনে হয় না।
দেশের মানুষ এ সব হতাশাজনক রাজনৈতিক শৃংখলের কথা দেশি-বিদেশি বিশ্লেষকদের কাছ থেকে শুনলেও প্রকৃতি কিন্তু বসে নেই। চারপাশের গাছপালা নীরবে গাইছে মুক্তির গান। এই কিছুদিন আগেও যেসব গাছগুলোকে টাকওয়ালা মানুষের মতো মনে হতো তারাও আজ নতুন পাতা ও ফুলে সজ্জিত। ফেব্রুয়ারি মাস বসন্তের মাস, ভালবাসার মাস, ভাষার মাস। এ খবর আমাদের আগে পৌঁছে যায় গাছপালার কানে। তাইতো ঘরের পাশে আম গাছে মুকুল এসেছে। অন্যান্য গাছ সবুজ পাতায় ধীরে ধীরে নিজেকে সজ্জিত করছে। শীতে জবুথবু প্রকৃতি কুয়াশার চাদর ফেলে বসন্তে শরিক হচ্ছে মুক্তির নিঃশব্দ মিছিলে। মাঝে মাঝে এক পশলা বৃষ্টি যেন স্বাগত জানাচ্ছে প্রকৃতির এই রূপ বদলকে।
মানুষের মুক্তির ইচ্ছাকে শাসকরা স্বাগত জানায় না। তবুও ইচ্ছা অবদমিত থাকে না। সবাই মুক্তি চায়। কখনও কখনও হয়তো দশকের পর দশক রক্ত পিচ্ছিল পথ পেরিয়ে যেতে হয়। দীর্ঘ কর্দমাক্ত রাস্তা সাবধানে পাড়ি দিতে হয়। পৃথিবীর সব জাতির মুক্তির যাত্রাপথ কম বেশি এরকমই হয়। রাজনৈতিক মুক্তির পরই মানুষকে সবচেয়ে বেশি শৃংখলিত করে অর্থনীতি। অনেক সময় ব্যক্তির আর্থিক অবস্থা তাকে রাজনীতির চেয়েও শতগুন বেশি দাসত্বের শৃংখলে আবদ্ধ রাখে। অর্থনৈতিক মুক্তি ব্যতীত রাজনৈতিক স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহন করা কঠিন। মানুষের চিন্তা ও কর্মের ঘরে যখন তালা দেয়া থাকে তখন মানুষ আপন ঘরে বন্দী হয়ে পড়ে।
সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন, অর্থনৈতিক সর্বোচ্চ সুবিধা প্রাপ্তি সত্বেও মানুষ অনেক সময় নিজেকে মুক্ত ভাবতে পারে না। আইন-কানুন, নিয়ম নীতির বেড়াজালে কেউ কেউ এরকম বন্দী জীবন যাপন করতে বাধ্য হন। উদাহরন হিসেবে আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদের কথা বলা যায়। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ অবস্থানে থেকেও হাস্যরসের মাধ্যমে তিনি তাঁর পরাধীনতার গল্প শুনিয়েছেন। ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি বলেছেন, তিনি এখন কী বক্তব্য দেবেন তা তিনি জানেন না। তাঁকে বক্তব্য লিখে দেয়া হয়েছে। কাগজে কী লিখা আছে পড়ার সময় পাননি। শরীর খারাপ। আসতে চাননি এই অনুষ্ঠানে তবুও আসতে বাধ্য হয়েছেন। শরীর খারাপ বলার কারণে এ অনুষ্ঠানের পর তাঁকে হাসপাতালে যেতে হবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে। যদিও তিনি জানেন এগুলো করার দরকার নেই। হাস্যরসের মাধ্যমে বলা কথার সারাংশ এরকমই ছিল। ইউটিউবে সার্চ দিলেই বক্তব্যটি পাওয়া যায়। কয়েকবার ইউটিউব থেকে বক্তব্যটি শুনেছি। আপনিও শুনতে পারেন। ভাবতে পারেন রাষ্টপতিই যেখানে মুক্ত মানুষ নন, সেখানে অন্যরা পরিপূর্ণ মুক্ত হবে কীভাবে? এতে মুক্তির আনন্দ না মিললেও কষ্ট অনেকটা কমে যাবে।
তবে আপনি যদি আর্থিক দৈন্য বা সীমাবদ্ধতার মধ্যে থাকেন, তাহলে কোনো কিছুই আপনার কষ্ট কমাতে পারবে না। পরিবারের সবার মুখে অন্ন তুলে দিতে যে রিক্সাচালক সারাদিন পরিশ্রম করে তার কাছে মুক্তি শব্দটিই হাস্যকর। সে জীবনে মুক্তির চিন্তা করে না। বরং জীবন থেকে মুক্তি চায়। দু‘দিন বিছানায় পড়ে থাকলে এসব বিত্তহীন প্রান্তিক আয়ের মানুষের রোগের চেয়ে ক্ষুধায় মারা যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তবে এসব প্রান্তিক আয়ের দিনমজুর শ্রেণির মানুষ পেশা পরিবর্তনের সুযোগ নিতে পারে। কেউ আজ রিক্সাচালক, কাল ঠেলাগাড়ি, পরশু হয়তো কোদাল হাতে মাটি কাটার কাজে ব্যস্ত। কারণ এদের পেশা পরিবর্তনের সুযোগ বেশি এবং তাতে আর্থিক অবস্থারও খুব একটা তারতম্য হয় না।
কিন্তু সমাজে তুলনামূলকভাবে যারা ভাল পেশায় রয়েছেন এবং মোটামুটি মানসম্মত জীবনযাপন করে অভ্যস্থ তাদের পেশা পরিবর্তনের সুযোগ নেই বললেই চলে। সংবিধানের ৪০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ি তারা স্বাধীনভাবে পেশা বা বৃত্তি গ্রহন করতে পারেন। অথচ তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা তাদেরকে সেই সুযোগ দেয় না। একজন সাংবাদিক মধ্যবয়সে যদি তার সম্পাদক বা মালিক পক্ষের উপর বিরক্ত হয়ে পেশা পরিবর্তন করতে চান তাহলে তিনি বিকল্প কোনো কিছুই খুঁজে পাবেন না। এভাবে শিক্ষক, ব্যাংকার, আইনজীবি সহ যেকোনো পেশার ক্ষেত্রে একই অবস্থা। কেউই পেশা পরিবর্তন করে নতুন কোথাও ভিন্ন পেশায় যাওয়ার সুযোগ নেই। ব্যবসা-বাণিজ্যসহ স্বাধীন কোনো পেশা গ্রহন করার ঝুঁকি বহনের আর্থিক সামর্থ্যও নেই। একটা জায়গায় প্রতিষ্ঠিত অবস্থা থেকে ভিন্ন জায়গায় যেতে বা প্রতিষ্ঠা পেতে যে ন্যুনতম সময় দরকার ওই সময়ে তার পরিবার কীভাবে চলবে এ হিসাব মিলে না বলেই এরা স¦াধীনভাবে পেশা বা বৃত্তি গ্রহনের সাংবিধানিক অধিকার ভোগ করতে পারে না। এখানে সরকার বা আইন তাকে বাাঁধা দিচ্ছে না। ব্যক্তির আর্থিক অবস্থাই তার স্বাধীনতার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়।
সম্প্রতি সুইজারল্যান্ডের জনগন এ সমস্যা সমাধানের জন্য একটি আন্দোলন শুরু করেছে। তারা চাকরিজীবি বা বেকার সবার জন্য ভাতা চায়। তাদের দাবি সবাইকে ২৫০০ সুইস ফ্রাংক (২৮০০ ডলার) দিতে হবে। এ পরিমান আমেরিকার জনগনের গড় মাসিক আয়ের চেয়েও কিছুটা বেশি। এই প্রস্তাবের পক্ষে বিপক্ষে জনমত রয়েছে। বিষয়টি মিমাংসার জন্য এ বছর গনভোট হতে পারে। গনভোটে প্রস্তাব পাশ হবে কি-না সেটা ভিন্ন প্রশ্ন। আন্দোলনকারীদের মূল উদ্দেশ্য তারা নিশ্চিত করতে চায় কেউ যেন তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শুধুমাত্র আর্থিক কারণে কোনো পেশা চালিয়ে যেতে বাধ্য না হয়। বিবিসির প্রতিবেদককে আন্দোলনকারী চে ওয়াগনার বলেছেন, ঞযব রফবধ মড়বং ঃড় ঃযব ঢ়বৎংড়হধষ য়ঁবংঃরড়হ – যিধঃ ধৎব ুড়ঁ ফড়রহম রহ ুড়ঁৎ ষরভব, রং রঃ ধপঃঁধষষু যিধঃ ুড়ঁ ধিহঃ ঃড় ফড়?
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এরকম দাবি এই মুহুর্তে হাস্যকর লাগবে। ভবিষ্যতে হয়তো সময় আসবে যখন এটাকে সবাই প্রয়োজনীয় মনে করতে পারে। তবে এখন বাংলাদেশের বীমা কোম্পানীগুলো এই ধারণার ভিত্তিতে বীমা প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে আসতে পারে। এতে অনেকেই উপকৃত হবে।
বসন্তের এই দিনে পুরনো সব জরাজীর্ণ থেকে মুক্তি লাভ করে সবাই নিজেকে সুন্দরতম সাজে সাজাই নতুন রূপে। ভালবাসার মাস ফেব্রুয়ারিতে সব ধরণের ঘৃণা থেকে মুক্তি লাভই হোক কাম্য। আর সবশেষে ভাষার মাস, বইমেলার মাসে বই কিনে জ্ঞানের রাজ্যে হাঁটা শুরু করি। কারণ জ্ঞানই সার্বিক মুক্তির প্রথম সোপান। শিখা গোষ্ঠীর সেই চিরায়ত শ্লোগানকে আজও মাথা পেতে নিতে হবে- ‘ জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।‘
লেখক: ব্যাংকার ও কলাম লেখক