মৃত ব্যক্তির ব্যাংক হিসাবের টাকার মালিকানা ও নমিনি বিতর্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ১১:৪৭:১৯,অপরাহ্ন ১৮ এপ্রিল ২০১৬ | সংবাদটি ১৭৭৬ বার পঠিত
মো. মাহমুদুর রহমানঃ গত কয়েক বছর থেকে বাংলাদেশে ব্যাংকিং সেক্টর আলোচনা সমালোচনার শীর্ষে থাকায় মিডিয়ায় বেশ গুরুত্ত্ব পাচ্ছে। তবে এসবের বেশিরভাগই নেতিবাচক কারণে। বিভিন্ন ধরনের ঋণ কেলেঙ্কারি ও জালিয়াতিই গুরুত্ত্ব পেয়েছে এতে। হলমার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ থেকে শুরু করে সর্বশেষ সংযোজন বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ কেলেঙ্কারি। যাকে কেউ হ্যাকিং, আবার কেউ রাজকোষ চুরি হিসেবে বর্ণনা করছেন। দেশের বাইরের একটি ঘটনায়ও এবার একটি বিদেশী ব্যাংক আলোচনায় এসেছে যার শাখা রয়েছে বাংলাদেশে। ’পানামা পেপারস’ কেলেঙ্কারিতে এইচএসবিসি ব্যাংকের নাম এসেছে। বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রপ্রধান ও তারকাদের সাথে বাংলাদেশের যাদের পানামা পেপারসে নাম এসেছে তারা যদি সত্যি টাকা পাচার করে থাকেন তাহলে হয়তো তারা এইচএসবিসি ব্যাংক ব্যবহার করে থাকতে পারেন বলে বিশেজ্ঞরা অনুমান করছেন। এতসব নেতিবাচক খবরের মধ্যে ভিন্ন কোনো খবর মিডিয়ায় আসার সুযোগই নেই। যদিও দেশের ব্যাংকিং সেক্টর বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থানের বিশাল একটি খাত। সরকারও এ খাত থেকে বড় ধরনের রাজস্ব আহরণ করে থাকে। তবে সম্প্রতি ভিন্ন একটি খবর মিডিয়ায় বেশ গুরুত্ত্ব পেয়েছে। গ্রাহকরাও খবরটি নিয়ে আগ্রহী এবং কিছুটা বিভ্রান্ত। অনেকেই ফোনে জানতে চেয়েছেন তাহলে এখন থেকে নমিনি কি টাকা নিতে পারবে না?
ঘটনার সূত্রপাত বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি ডিরেক্টর শহীদুল হক চৌধুরীর মৃত্যুর পর। মৃত্যুর আগে ২০১৪ সালে তিনি ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কিনেন। যেখানে নমিনি হিসেবে নাম দেন তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর। উনার মৃত্যুর পর প্রথম স্ত্রী পক্ষের ছেলেরাও টাকার ভাগ দাবি করে। কিন্তু নি¤œ আদালত তাদের দাবি নাকচ করে নমিনির পক্ষে রায় দেন। ছেলেরা তখন এই রায়ের বিরুদ্ধে মহামান্য হাইকোর্টে আপিল করেন। বিচারপতি নাঈমা হায়দারের বেঞ্চ গত ৩ এপ্রিল নি¤œ আদালতের রায় নাকচ করে ছেলেদের পক্ষে রায় দেন। রায়ে নমিনি নয় উত্তরাধিকারীরা টাকা পাবে এবং নমিনির কাজ একজন ট্রাস্টির মতো হবে বলে উল্লেখ করা হয়। বিভিন্ন পত্রিকা ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় এভাবেই রায়ের সারসংক্ষেপ আসে। সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংকিং খাতে প্রচলিত একটি নিয়ম নিয়েও মানুষ বিভ্রান্তিতে পড়ে। অনেকের প্রশ্ন ব্যাংক কি তাহলে আর আগের মতো নমিনির কাছে মৃত ব্যাক্তির হিসাবের টাকা দেবে না? নাকি আদালত থেকে সাকসেসন সার্টিফিকেট নিয়ে এসে টাকা উত্তোলন করতে হবে?
এসব প্রশ্নের উত্তর জানার আগে ব্যাংকে হিসাব খোলার ক্ষেত্রে নমিনির বিধান জেনে রাখা দরকার। এক সময় হিসাব খোলার ক্ষেত্রে নমিনির নাম দেয়া বাধ্যতামূলক ছিল না। তখন কেউ ইচ্ছা করলে নমিনি দিতে পারতেন। আবার নাও দিতে পারতেন। এতে অনেক সমস্যা হতো। যে বা যারা নমিনি না রেখে মৃত্যুবরণ করতেন তাদের উত্তরাধিকারদের পোহাতে হতো অনেক আইনি ঝামেলা। আদালত থেকে সাকসেসন সার্টিফিকেট নিয়ে টাকা উত্তোলন করতে হতো। আদালত থেকে সাকসেসন সার্টিফিটিকেট নিতে অনেক সময়ের দরকার হয়। মধ্যবর্তী এ সময়ে মৃত ব্যক্তির পরিবারকে আর্থিক সমস্যায় দিনাতিপাত করতে হতো যদি তাদের ব্যাংক হিসাবের বাইরে কোনো টাকা না থাকতো। ব্যাংকিং সেক্টরে দীর্ঘদিন এ তিক্ত অভিজ্ঞতা মোকাবেলা করে ইদানিং হিসাব খোলার ক্ষেত্রে নমিনির নাম দেয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। এতে মৃত ব্যক্তির টাকা উত্তোলনে নমিনি এবং ব্যাংক কর্মকর্তা উভয়ের জন্য সহজ হয়ে পড়ে। মৃত ব্যক্তির মৃত্যু সনদ এবং নমিনি তার নিজের পরিচয় পত্র নিয়ে এলেই ব্যাংক টাকা দিতে বাধ্য।
কিন্তু নমিনির ক্ষেত্রেও কিছু কিছু সমস্যা দেখা দেয়। উত্তরাধিকার সবার নাম নমিনি হিসেবে একাউন্ট খোলার সময় সংযুক্ত করার সুযোগ নেই। এতে অনেক উত্তরাধিকাররা মৃত ব্যক্তির অনিচ্ছা সত্ত্বেও নগদ টাকার মালিকানা থেকে বাদ পড়ে যান। আবার অনেকেই নমিনির ভুমিকা সম্পর্কে পুরোপুরি না বুঝেই যাকে তাকে নমিনি করেন। মাঝে মাঝে দেখা যায় ব্যবসার প্রয়োজনে ভিন্ন জেলায় বসবাসরত অনেকেই নিজের রুমমেট বা পরিচিত কাউকে নমিনি হিসেবে দেন। যেমন বরিশালের একজন লোক সিলেটে ব্যবসা করেন। ভদ্রলোকের পরিবারের সদস্যরা বরিশালে থাকেন। তিনি একা সিলেটে থেকে ব্যবসা পরিচালনা করেন। ব্যবসার প্রয়োজনে যখন সিলেটে তার একটি একাউন্ট খোলার দরকার হয় তখন তিনি নিজের ছবি ও আইডি কার্ড নিয়ে ব্যাংকে যান। ব্যাংক কর্মকর্তা নমিনির ছবি ও আইডি কার্ড চাইলে তিনি হয়তো পরিচিত কারো ছবি-আইডি নিয়ে এসে তাড়াতাড়ি একাউন্ট খোলেন। একাউন্ট খোলার সময় এর পরিণতি খুব একটা তোয়াক্কা করেন না। আসলে জীবনের সবচেয়ে বড় সত্যি ’মৃত্যু’কে আমরা অস্বীকার করতে না পারলেও বিশ্বাস করি না। তাই যেকোনো সময় মৃত্যুর জন্য আমরা কেউই প্রস্তুত নই। ব্যাংক একাউন্ট খোলার সময়ও আমরা ধরে নেই ব্যাংকের নিয়মের জন্য নমিনি দেয়া হয়েছে কিন্তু টাকাগুলো আমিই উত্তোলন করব। নমিনির প্রয়োজন কোনোদিনই পড়বে না, কারণ এই একাউন্ট রেখে আমি মরব না। মরার আগে সবকিছু গুছিয়ে যার যার পাওনা তার হাতে দিয়েই মরব। তখন একাউন্টে কোনো টাকা থাকবে না বিধায় নমিনিকে কিছু করতে হবে না। অথচ চোখের সামনে প্রতিদিন কেউ না কেউ কোটি কোটি টাকা ব্যাংক একাউন্টে রেখে মারা যাচ্ছে। আবার অনেকে ভাবেন- আমার তো এত টাকা নেই। তাই একাউন্টে খুব বেশি টাকা থাকবে না। সুতরাং যে কেউ নমিনি হলেও সমস্যা নেই। কিন্তু এমনও হতে পারে যে, কোনো সম্পদ বিক্রি করে জীবনে একদিন আপনার ব্যাংক একাউন্টে বড় অঙ্কের টাকা জমা হলো এবং ওইদিনই আপনি মারা গেলেন! একথা গুলো আমাকে প্রায়ই বলতে হয় যখন কেউ একাউন্ট খোলতে আসেন আমার ব্যাংকে। একজন ব্যাংকার গ্রাহককে নমিনির গুরুত্ত্ব বুঝিয়ে না দিলে গ্রাহকের ভুল সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ থেকে যায়। কেউ কেউ ছোট বাচ্চার নাম নমিনি হিসেবে দিতে চায়। যখন তাকে বলা হয় প্রাপ্ত বয়স্ক কারো নাম নমিনি হলে ভালো হয় কারণ আপনি এখন মারা গেলে আপনার নমিনি প্রাপ্ত বয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত টাকা তুলতে পারবে না। এ সময় অনেকের চেহারাই ফ্যাকাশে হয়ে পড়ে। মেনে নিতে পারেন না যে তার মৃত্যু সন্তান প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার আগেই হতে পারে। জীবনের চরম বাস্তবতা মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচতে চাইলেও এ চেষ্টা সবারই ব্যর্থ হয়।
এভাবে ব্যাংক একাউন্টে নমিনি সংয্ক্তু করার উদ্দেশ্য ও প্রক্রিয়া বিবেচনায় নিলে দেখা যায় বেশিরভাগ হিসাবধারীই নমিনিকে মৃত্যুর পর টাকার মালিক বানাতে নমিনি করেননি। এক্ষেত্রে একটি সাধারণ ব্যতিক্রম হচ্ছে যাদের ছেলে সন্তান নেই শুধু মেয়ে সন্তান তারা। মুসলিম পারিবারিক আইনে মেয়ে সন্তানের বাইরেও উত্তরাধিকার তৈরী হওয়ায় এদের অনেকেই মেয়েদের টাকার মালিক অর্থে নমিনি হিসেবে দিতে চান। তবে সামগ্রিক পরিস্থিতির আলোকে বলা যায় বেশিরভাগ হিসাবধারী নমিনি হিসেবে যাদেরকে দেন তাদেরকে টাকার মালিক নন ট্রাস্টি হিসেবে দেখতে চান। তিনি শুধু হিসাবধারীর মৃত্যুর পর টাকা উত্তোলন করে প্রকৃত উত্তরাধিকারদের মধ্যে বণ্টন করে দেবেন। নিজেও একজন উত্তরাধিকারী হলে নিজের অংশ নিজে নেবেন। তাই মহামান্য হাইকোর্টের রায় বাস্তবতার আলোকে একটি সময়োপযোগী রায় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
এই রায়ে ব্যাংকারদের কর্তব্যে কোনো পরিবর্তন হয়নি। ব্যাংকাররা আগেও নমিনিকে টাকা দিতেন, এখনও নমিনির হাতে টাকা দেবেন। তবে আগে নমিনি নিজেকে টাকার মালিক হিসেবে মৃত ব্যক্তির হিসাবের টাকা উত্তোলন করতেন। এখন থেকে একজন ট্রাস্টি হিসেবে টাকা উত্তোলন করে প্রকৃত মালিক/মালিকদের হাতে টাকা তুলে দেবেন। যদি কোনো নমিনি এই দায়িত্ব পালনে অনিয়ম করে থাকেন তাহলে মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকাররা তাঁর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারেন।
মামলার চুড়ান্ত নিষ্পত্তি এবং পূর্ণ রায় প্রকাশের পর আরও বিস্তারিত দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে জানা যাবে। তখন ব্যাংকগুলো অবশ্যই সার্কুলার আকারে কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেবে। এতে ব্যাংকার ও গ্রাহকদের বিভ্রান্তি দূর হবে।
লেখক: ব্যাংকার ও কলাম লেখক।